এমটিনিউজ ডেস্ক: ‘আমি ওকে জিজ্ঞাসা করি কেমন আছো? ও বলে আমার কোনো সমস্যা নাই! তুমি কেমন আছো? আমার আব্বা কেমন আছে? মা কেমন আছে? ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। ও বললো আমার কোনো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেও একই কথা বলে। এরপর ডাক্তার আমাকে চলে যেতে বললো। তখন আমি ওখান থেকে চলে আসি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে নিহত মিনারুল ইসলামের স্ত্রী সুরাইয়া ফেরদৌস কণা। স্বামীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে এমন কথাই হয়েছিলো তার। মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে প্রথমে শ্বশুর এরপর স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি।
মিনারুল ইসলাম ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের ফরমান মন্ডলের ছেলে। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।শুক্রবার (১৮ আগস্ট) সকাল ১০টায় হরিণাকুন্ডু বাকচুয়া লক্ষ্মীপুর বেসরকারি মাধ্যমিক বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে লক্ষ্মীপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে মিনারুলকে দাফন করা হয়। তার জানাজায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আনিচুর রহমান খোকা, হরিণাকুন্ডু উপজেলা চেয়াম্যান মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, হরিণাকুন্ডু পৌরসভার মেয়র ফারুক হোসেন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রানা হামিদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের বোর্ডবাজারের মুক্তারবাড়ি এলাকার জমির উদ্দিন রোডে মিনারুল ইসলাম তার স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে বসবাস করতেন। গত রোববার (১৩ আগস্ট) বিকেলে তাদের রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজার থেকে একটি গ্যাসের সিলিন্ডার আনা হয়। কিন্তু সিলিন্ডারটি চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার পর গ্যাস জ্বলছিল না। পরে সিলিন্ডারের দোকান থেকে একজন মিস্ত্রি নিয়ে এসে তা মেরামত করা হয়। মেরামত শেষে চুলা জ্বালাতে গেলে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে রান্নাঘরে থাকা মা খাদিজা বেগম, পাশের কক্ষে থাকা মিনারুল ও তার বাবা ফরমান মণ্ডল অগ্নিদগ্ধ হন। এ সময় তার স্ত্রী ও সন্তান অন্য একটি কক্ষে থাকায় রক্ষা পান।
বিস্ফোরণে ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পরে আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেন। সেখানে গত সোমবার (১৪ আগস্ট) বাবা ফরমান মণ্ডল ও বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) মিনারুল মারা যান। মা খাদিজা বেগম শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
মিনারুলের স্ত্রী সুরাইয়া ফেরদৌস কণা বলেন, সংসার জীবনে আদর্শ স্বামী ছিল মিনারুল। সব কিছুতেই সে মেসিউরড ছিল। প্রতিদিন আমাকে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাতো। কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। যখন যেভাবে চেয়েছি ঠিক সেই ভাবেই আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। এখন সে নিজেই স্বপ্নের রাজ্যে চলে গেছে। আমাদের ৯ মাসের একটি বাচ্চা (মুনতাহা), ওকে আমি কী বলে ঘুম পাড়াবো।
মিনারুলের ছোট ভাই আনারুল মিয়া বলেন, গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজারের মুক্তারবাড়ি এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন বড় ভাই মিনারুল। বাবা-মা ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা ১৭ জুলাই কুষ্টিয়ার পুড়াদহ রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে করে ঢাকা যান। ওই দিনই সন্ধ্যায় ভাইয়ের বাসায় পৌঁছান।
গত ১৩ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে গ্যাসের পাইপ লিক হয়ে গ্যাস বের হয়ে গেলে গ্যাসের মিস্ত্রি আসে সেটি ঠিক করার জন্য। এরইমধ্যে গ্যাস বের হয়ে পুরো রান্না ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। যা তারা বুঝতে পারেনি। পরে মিস্ত্রি থাকা অবস্থায় চেক করতে গেলে বাতাসে ছড়িয়ে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে যায় এবং গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটে। তখন বাবা, মা, ভাইসহ মিস্ত্রির গায়ে আগুন ধরে যায়। মিস্ত্রি আগুন গায়ে ঘর থেকে দৌড়ে বের হন। কিন্তু বাবা, মা ও ভাই বের হতে পারেন না। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই ঘটনায় ১৪ আগস্ট বাবা মারা যান। তার তিন দিন পর ১৭ আগস্ট ভাই মিনারুলও মারা যান। মা এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর লড়ছেন।
তিনি বলেন, বাবা মারা গেছে মা জানতো না। আবার ভাই মারা গেল তাও মাকে জানাতে পারিনি। ডাক্তার বলেছে, বাবা ও ভাই মারা যাওয়ার সংবাদ মাকে জানালে মাও স্ট্রোক করে মারা যেতে পারে। ভাইয়ের ৯ মাসের এক মেয়ে মুনতাহা ছাড়া তার কোনো সন্তান নেই।
মিনারুলের সহকর্মী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, কর্মজীবনে নিজের কাজের পাশাপাশি সব সময় অন্যকে উপকার করতেন। সহকর্মীদের কোনো সমস্যা হলে মুহূর্তের মধ্যে সেগুলো সমাধান করে দিতেন। তিনি সৎ ও পরোপকারী ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি সফল ছিলেন।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই মিনারুল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনীতিতে মানুষের জন্য কাজ করা খুবই কঠিন, কিন্তু সেই কঠিন কাজটি মিনারুল করে দেখিয়েছেন। তার সঙ্গে পরিচয় হবার পর তিন শতাধিক ছেলে-মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েও অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারেনি, কে কি করে, কোন দল করে তাও জানতাম না, মিনারুলের সহযোগিতা এবং অনুরোধে তাদেরকে ভর্তি করেছি। কিন্তু শেষবারের মত তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। ১৫ আগস্টে বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম থাকার কারণে সময় মতো যেতে পারিনি, কথা বলতে পারিনি। পরে যখন ওর সঙ্গে দেখা হয় তখন আর কথা বলার মতো ছিল না। পরে আমি ফিরে আসার পর পর শুনি মিনারুল মারা গেছে। মিনারুলের শূন্যস্থান কেউ পূরণ করতে পারবে না।
মিনারুল ইসলাম বাকচুয়া লক্ষ্মীপুর বেসরকারি মাধ্যমিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে (মানবিক শাখা) এসএসসি পাস করেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০০৬ (মানবিক শাখা) এইচএসসি পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ থেকে ২০১১ সালে (২০০৭-০৮ সেশন) অনার্স পাস করেন এবং ২০১২ সালে মাস্টার্স (এমবিএ) শেষ করেন। তিনি পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ।