রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ০৯:২৯:৫৬

পবিত্র কাবা শরীফের বরকত ও বৈশিষ্ট্য

পবিত্র কাবা শরীফের বরকত ও বৈশিষ্ট্য

ইসলাম ডেস্ক : পবিত্র কাবা শরিফ পৃথিবীতে আল্লাহর জীবন্ত নিদর্শন। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আল্লাহ তাআলা কাবাকে তাঁর মনোনীত বান্দাদের মিলনমেলা হিসেবে কবুল করেছেন। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। যা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত। এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন ড. হুসাইন কামাল উদ্দীন আহমদ। এ বিষয়ে তাঁর থিসিসের শিরোনাম হলো—‘ইসকাতুল কুর্রাতিল আরধিয়্যা বিন্ নিসবতে লি মাক্কাতিল মুকার্রামা।’ (মাজাল্লাতুল বুহুসুল ইসলামিয়া, রিয়াদ : ২/২৯২)

ওই থিসিসে তিনি প্রাচীন ও আধুনিক দলিল-দস্তাবেজের আলোকে এ কথা প্রমাণ করেছেন যে কাবাই পৃথিবীর মেরুদণ্ড ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে অবস্থিত। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পানিসর্বস্ব পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি এ কাবাকে কেন্দ্র করেই। মক্কা ও কাবার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইব্রাহিম (আ.)-এর পদচিহ্ন-স্মৃতি। ইহুদি ও নাসারাদের নবীরা তাঁরই সুপুত্র ইসহাক (আ.)-এর বংশোদ্ভূত হওয়ায় কাবার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য তাদের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত।

কাবাগৃহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সুপ্রাচীন ঘর। কোরআনের ভাষায়, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬)

কাবা শরিফ গোটা বিশ্বের স্তম্ভস্বরূপ, বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ও বাইতুল্লাহর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ সম্মানিত গৃহ কাবাকে মানুষের স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৯৭)

ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে কাবাকে কেন্দ্র করে। নামাজ, হজ, কোরবানি, পশু জবাই ও মৃতের দাফনসহ অনেক ইবাদত আদায় করতে হয় কাবার দিকে ফিরে। হাদিসের ভাষ্য মতে, কাবাগৃহে এক রাকাত নামাজ আদায় করলে এক লাখ রাকাত নামাজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। কাবা শরিফের এ বিশেষ মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের কথা বিবেচনা করে ইসলাম কাবার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বসবে, সে যেন কাবাকে সামনে বা পেছনে না রাখে।’ (মুসলিম শরিফ)

আল্লাহর নির্দেশে সর্বপ্রথম সেখানে কাবাঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ফেরেশতারা। আদম (আ.)-এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে কাবার সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা যখন ফেরেশতাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, তখন তাঁরা আসমানে বায়তুল মামুরের আদলে নির্মিত একটি ইবাদতখানার জন্য প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাআলা এর আদলে পৃথিবী সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে ফেরেশতাদের মাধ্যমে কাবা সৃষ্টি করেন। তখন তা সাদা ফেনা ছিল। সে সময় পৃথিবীতে পানি ছাড়া কিছু ছিল না। আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর। হাদিসের ভাষ্য মতে, কাবার নিচের অংশটুকু পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে এর সৃষ্টি। ধীরে ধীরে এর চারপাশ ভরাট হতে থাকে। সৃষ্টি হয় একটি বিশাল মহাদেশের। এক মহাদেশ থেকেই সৃষ্টি হয় অন্য সব মহাদেশ। মাটি বিছানোর পর জমিন নড়তে থাকে। হেলতে থাকে। এর জন্য আল্লাহ পাহাড় সৃষ্টি করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয় (হেলে না যায়)।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১৫)

বেহেশত থেকে দুনিয়ায় আগমনের পর হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর অনুরোধে সেটিকেই তাঁদের ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করে দেন আল্লাহ তাআলা। নুহ (আ.)-এর সময়কার মহাপ্লাবনে কাবাঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশে আবার কাবা শরিফ পুনর্নির্মাণ করেন হজরত ইব্রাহিম (্আ.) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.)। তার পর থেকে কখনো বন্ধ থাকেনি কাবাঘরের জিয়ারত। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আমলে এ আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণতা পায়। নবুয়ত লাভের ২২ বছর পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হজ পালন করেন রাসুল (সা.)। তাঁর দেখানো নিয়ম অনুসারেই প্রতিবছর শান্তিপূর্ণভাবে হজ পালন করেন লাখ লাখ মুসলমান।

কাবার প্রাঙ্গণে জমে উঠছে মুসলমানদের আন্তর্জাতিক মিলনমেলা। স্মরণাতীতকাল থেকে মক্কায় হজব্রত পালনকারীদের জমায়েত বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাগৃহ নির্মিত হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দেন, ‘বিশ্ববাসীকে এ ঘর তওয়াফ করার আহ্বান জানাও’। তিনি আরজ করেন, ‘হে প্রভু! এখানে তো জনমানবহীন প্রান্তর। আমার আহ্বান জগদ্বাসী কিভাবে শুনবে? আল্লাহ বলেন, তোমার দায়িত্ব কেবল ঘোষণা দেওয়া। পৌঁছানো আমার কাজ। তারপর তিনি মাকামে ইব্রাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘ওহে লোক সকল, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করে তার জিয়ারত তোমাদের ওপর ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা এ ঘর প্রদক্ষিণ করতে এসো।’ পয়গম্বরের এ আওয়াজ মহান আল্লাহ বিশ্বের কোণে কোণে পৌঁছে দেন। কিয়ামত অবধি যত মানুষের আগমন ঘটবে এ ধরণীতে, সবার কানে এ আওয়াজ পৌঁছেছে। যারা ‘লাব্বাইকা’ বলেছেন, তাঁরা এ ঘরের জিয়ারত করে ধন্য হবেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হজে ‘লাব্বাইকা’ বলে যে তালবিয়া পাঠ করা হয়, তা ইব্রাহিম  (আ.)-এর সেই আহ্বানেরই জবাব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা প্রচার করো। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ২৭)

পবিত্র কাবা বিশ্বমোমেনের সম্মিলনস্থল। ঐক্যের প্রতীক। ভালোবাসার স্পন্দন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কাবা ঘরকে মানুষের প্রত্যাবর্তনস্থল ও শান্তির আঁধার করেছি।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১২৫) কাবাগৃহের অসিলায় আল্লাহ মক্কাবাসীকে সর্বদা শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদে রেখেছেন। কাবা ধ্বংস করতে আসা হাবশার দাম্ভিক সম্রাট আবরাহাকে অতি ক্ষুদ্র পাখি দ্বারা সদলবলে নিচিহ্ন করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি মক্কাকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল করেছি। অথচ এর চতুষ্পার্শ্বে যারা রয়েছে, তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। তবে কি তাঁরা মিথ্যায় বিশ্বাস করবে এবং আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করবে?’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৬৭)

কাবার সীমানায় প্রবেশকারী জীবজন্তুও নিরাপদ জীবন লাভ করে।

পবিত্র কাবা অফুরন্ত কল্যাণ ও বরকতের প্রতীক। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম নির্মিত ঘর বাক্কায় অবস্থিত। এ ঘর বরকতময় এবং বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়েতস্বরূপ। এতে রয়েছে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন। মাকামে ইব্রাহিম তার একটি। যে ব্যক্তি এর ভেতরে প্রবেশ করে, সে নিরাপত্তা লাভ করে। (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬-৯৭)

আদিকাল থেকেই এ গৃহের ইবাদত ও সম্মান অব্যাহত রয়েছে। জাহেলি যুগে মক্কাবাসী মূর্তিপূজায় লিপ্ত থাকলেও তারা কাবাকে যথেষ্ট সম্মান দেখাত। তারা কাবার রবের নামে শপথ করত। কাবার দেয়ালে কবিতা টানিয়ে রাখত। বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করত, হজ, ওমরাহ পালন করত ও বহির্দেশ থেকে আগত হাজিদের খেদমত করত। রাসুল (সা.)-এর সময় কুরাইশ কর্তৃক বায়তুল্লাহ পুনর্নির্মাণের পর হাজরে আসওয়াদ স্থাপনকে কেন্দ্র করে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক গোত্রই কামনা করছিল এই অনন্য মর্যাদার কাজটি যেন তারা আনজাম দেয়। অবশেষে রাসুল (সা.)-এর বিজ্ঞোচিত ফয়সালায় সবাই সন্তুষ্ট হন। কুরাইশদের অঙ্গীকার ছিল যে তারা পতিতাবৃত্তি, চুরি, সুদ ইত্যাদি অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ বায়তুল্লাহ নির্মাণের কাজে ব্যবহার করবে না। কেননা আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্রতা ভালোবাসেন।  

কাবার চতুষ্পার্শ্বে রয়েছে বরকতময় বহু নিদর্শন। মাকামে ইব্রাহিম, মুলতাজিম, হাজরে আসওয়াদ, মিজাবে রহমত, হাতিম, মাতাফ, রুকনে ইয়ামানি—প্রত্যেকটি বরকতের আধার। এগুলোর কাছে দোয়া করলে তা কবুল হয়। এ কারণেই কাবার পানে মোমেন হৃদয় বারবার ছুটে যায়। এটি কাবার বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যও বটে। আধুনিক দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম কোনো মনোরম দৃশ্য বা পর্যটনস্পট এক-দুবার পরিদর্শনেই মানব মন পরিতৃপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু শুষ্ক বালুকাময় মরু আরবের কাবাঘরে না আছে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট, না আছে চিত্তাকর্ষক কোনো বস্তু। তবুও সেখানে পৌঁছার আকুল আগ্রহ মোমেনের মনে ঢেউ খেলতে থাকে। সে আগ্রহে কখনো ভাটা পড়ে না।-কালেরকন্ঠ
১৪ আগস্ট ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে