ইসলাম ডেস্ক: যে সূরা দিয়ে পবিত্র কোরআনে কারিম শুরু করা হয়েছে তার প্রসিদ্ধ নাম সূরাতুল ফাতিহা। ফাতিহা আরবি শব্দ, অর্থ সূচনা। এটা শুধুমাত্র কোরআন লেখার সূচনা নয় বরং নামাজে কেরাত পাঠের সূচনাও এ সূরা দিয়ে করতে হয়। ফাতিহা ছাড়া এ সূরার আরো কিছু নাম রয়েছে। ওইসব নামের মধ্যে ‘উম্মুল কোরআন বা কোরআনের জননী’ নামটি বেশি প্রসিদ্ধ।
আল-কুরআন আল্লাহ্র বাণী, যা জিবরাঈল (আঃ) মারফত সুদীর্ঘ ২৩ বছরে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়। আল-কুরআনকে আল্লাহ রাববুল আলামীন সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির দিশারী বা পথপ্রদর্শক রূপে নাযিল করেছেন। আল-কুরআনের ভূমিকা হ’ল সূরাতুল ফাতিহা। এটিকে আবার আল-কুরআনের সারসংক্ষেপও বলা হয়। তাই সূরা ফাতিহা পবিত্র কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা। আলোচ্য নিবন্ধে এ সূরার ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।-
সূরা ফাতিহার ফযীলত :
এ সূরার ফযীলত অপরিসীম। এর ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি এখানে পেশ করা হ’ল-
(১) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ উম্মুল কুরআনের মত তাওরাত ও ইঞ্জীলে কিছু্ নাযিল করেননি। এটিকেই বলা হয়, ‘আস-সাব‘উল মাছানী’ (বারবার পঠিত সাতটি আয়াত), যাকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। আর আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, সে যা চাইবে’।
(২) সাঈদ ইবনু মু‘আল্লা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি মসজিদে ছালাত আদায় করছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে ডাক দিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন না। অতঃপর ছালাত শেষে এসে বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! আমি ছালাত আদায় করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আল্লাহ কি বলেননি, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও, যখন তোমাদেরকে ডাকা হয়?’ (আনফাল ২৪)। অতঃপর আমাকে বললেন, মসজিদ থেকে তোমার বের হওয়ার পূর্বেই আমি তোমাকে অবশ্যই কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি শিক্ষা দিব। অতঃপর তিনি আমার হাত ধরলেন। যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হ’তে চাইলেন, তখন আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, আপনি কি আমাকে বলেননি যে, তোমাকে আমি কুরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি শিক্ষা দিব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, সূরাটি হচ্ছে الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ এটিই সাবউল মাছানী এবং কুরআনুল আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে’।
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করল, আর সূরা ফাতিহা পড়ল না তার ছালাত অসম্পূর্ণ, কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। ছালাত সম্পূর্ণ নয়। বলা হ’ল, হে আবু হুরায়রা! আমরা কোন কোন সময় ইমামের পিছনে থাকি। তিনি বললেন, আপনি মনে মনে পড়ুন। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ বলেন, আমি ছালাতকে আমার মাঝে ও আমার বান্দার মাঝে ভাগ করে দিয়েছি। অর্ধেক আমার আর অর্ধেক আমার বান্দার। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা সূরা ফাতিহা পড়। কোন বান্দা যখন বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাবিবল আলামীন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। যখন বলে, আর-রহমা-নির রহীম, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে। বান্দা যখন বলে, মালিকি ইয়াউমিদ্দীন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। বান্দা যখন বলে, إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ আল্লাহ বলেন, এ হচ্ছে আমার ও আমার বান্দার মাঝের কথা। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়। বান্দা যখন বলে, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْمَ، صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّيْنَ আল্লাহ বলেন, এসব হচ্ছে আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়’।
(৪) ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (সা.)-এর ছাহাবীগণের এক দল এক পানির কূপওয়ালাদের নিকট পৌঁছলেন, যাদের একজনকে বিচ্ছু অথবা সাপে দংশন করেছিল। কূপওয়ালাদের এক ব্যক্তি এসে বলল, আপনাদের মধ্যে কোন মন্ত্র জানা লোক আছে কি? এ পানির ধারে বিচ্ছু বা সাপে দংশন করা একজন লোক আছে। ছাহাবীগণের মধ্যে একজন (আবু সাঈদ খুদরী) গেলেন এবং কতক ভেড়ার বিনিময়ে তার উপর সূরা ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিলেন। এতে সে ভাল হয়ে গেল এবং তিনি ভেড়াগুলি নিয়ে সাথীদের নিকট আসলেন। তারা এটা অপসন্দ করল এবং বলতে লাগল, আপনি কি আল্লাহ্র কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করলেন? অবশেষে তারা মদীনায় পৌঁছে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! তিনি আল্লাহ্র কিতাবের বিনিময় গ্রহণ করেছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা যেসব জিনিসের বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তার মধ্যে আল্লাহ্র কিতাব অধিকতর উপযোগী’। অন্য বর্ণনায় আছে নবী করীম (সা.) বললেন, ‘তোমরা ঠিক করেছ। ছাগলের একটি ভাগ আমার জন্য রাখ’।]
(৫) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ওবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর নিকট গেলেন, এ সময় তিনি ছালাত আদায় করছিলেন। নবী করীম (সা.) বললেন, হে ওবাই! তখন ওবাই (রাঃ) মুখ ফিরালেন, কিন্তু কোন সাড়া দিলেন না। অতঃপর ওবাই (রাঃ) হালকা করে ছালাত আদায় করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ফিরে এসে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! আস-সালামু আলাইকা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ওয়ালাইকাস সালাম। নবী করীম (সা.) বললেন, হে ওবাই! আমি যখন তোমাকে ডাকলাম, আমার ডাকে সাড়া দিতে তোমাকে বাধা দিল কে? ওবাই (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমি ছালাতের মধ্যে ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, কেন আল্লাহ অহী করে তোমাদের যা বলেছেন, তা কি তুমি পড়নি? আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমাদের ডাকেন, তোমরা তাঁদের ডাকে সাড়া দাও’ (আনফাল ২৪)। ওবাই (রাঃ) বললেন, হ্যাঁ হে আল্লাহ্র রাসূল (রাঃ)! আল্লাহ তো এভাবেই বলেছেন, আমি আর কখনও এ কাজ করব না। নবী করীম (সা.) বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি সূরা শিক্ষা দিব, যা (পূর্বে) কখনও নাযিল হয়নি। তাওরাতে হয়নি, যাবূরে হয়নি, ইঞ্জীলে হয়নি। অনুরূপ ফুরকান তথা কুরআন মাজীদেও নাযিল হয়নি। আমি বললাম, জি হ্যাঁ শিখিয়ে দিন হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি আশা রাখছি তুমি মসজিদ হ’তে বের হওয়ার পূর্বেই জানতে পারবে। ওবাই (রাঃ) বলেন, তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার হাত ধরে হাদীছ বলতে লাগলেন, আর আমি বিলম্ব করছিলাম এই ভয়ে যে, তিনি কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই দরজায় পৌঁছে যাবেন। অতঃপর আমরা যখন দরজার নিকট গেলাম, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)! সেই সূরাটি কি যা শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা করেছিলেন? নবী করীম (সা.) বললেন, তুমি ছালাতে কি পড়? ওবাই (রাঃ) বললেন, আমি তার সামনে উম্মুল কুরআন পড়লাম। নবী করীম (সা.) বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তাঁর কসম! আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফাতিহার মত কোন সূরা তাওরাত, যাবূর, ইঞ্জীল ও ফুরকান নামক কোন গ্রন্থে অবতীর্ণ করেননি। নিশ্চয়ই সূরা ফাতিহা হচ্ছে সাবউল মাছানী’।
(৬) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট জিবরাঈল (আঃ) ছিলেন, হঠাৎ জিবরাঈল (আঃ) উপর দিকে এক শব্দ শুনতে পেলেন এবং চক্ষু আকাশের দিকে করে বললেন, এ হচ্ছে আকাশের একটি দরজা যা পূর্বে কোনদিন খোলা হয়নি। সে দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হ’লেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বললেন, ‘আপনি দু’টি নূরের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। যা আপনাকে প্রদান করা হয়েছে। তা আপনার পূর্বে কোন নবীকে প্রদান করা হয়নি। তা হচ্ছে সূরা ফাতিহা এবং সূরা বাক্বারার শেষ দু’আয়াত। তুমি সে দু’টি হ’তে কোন অক্ষর পড়লেই তার প্রতিদান তোমাকে প্রদান করা হবে’।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/এমআর