সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:২১:১২

কেমন আছেন কিউবার নওমুসলিম হাসান-শাবানা?

কেমন আছেন কিউবার নওমুসলিম হাসান-শাবানা?

ইসলাম ডেস্ক : কেমন আছেন কিউবার নওমুসলিম হাসান-শাবানা? কিউবার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয় নগরী সান্টা কারার উপকণ্ঠের একটি ভবনের দোতলার বাইরে একটি হাতে লেখা বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘দলিলপত্র ছাপানো হয়’।

হাসান জান (৪৩) তার বাড়ির সামনের কক্ষে অস্থায়ী ছাপাখানা পরিচালনা করেন। এক সময়ের খোলামেলা বাড়িটি এখন চারটি ছোট ছোট বসবাসের উপযোগী বাড়িতে বিভক্ত করা হয়েছে। এ বাড়ির চারদিকে রয়েছে সোভিয়েত ধাঁচের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলো।

বাড়ির অন্যান্য অংশ থেকে সামনের কক্ষটিকে একটি পর্দা দিয়ে পৃথক করা হয়েছে। সেখানে একটি সোফা ও দু’টি চেয়ার পাতা রয়েছে। একপাশে গোল্ডফিশের একটি ট্যাংক। হাসান তার ধীরগতির লোভার্ড উইন্ডোজ প্রিন্টারের সাহায্যে কাজ করেন। ২০০৮ সালে আত্মকর্মসংস্থান নীতি শিথিল করার পর এ ধরনের বাড়িভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যাস্টিক ব্যবসায় এখন কিউবার সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

বাড়ির সামনের কক্ষ প্রায় টেলিফোন মেরামত কেন্দ্র, সেলুস ও এলাকাবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় দোকানে রূপান্তরিত করা হয়। হাসান প্রতি কপি প্রিন্ট দিতে এক কিউবান পেসো (.০৪ ডলার) নেন। এভাবে দিনে তিনি এক ডলারেরও বেশি রোজগার করে থাকেন। যা তার স্ত্রী শাবানা ও তাদের দুই সন্তানের সংসার নির্বাহ করার জন্য যথেষ্ট।

কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত হাসানের চোখ দু’টো নীল বর্ণের। তিনি অনেক মুসলিম দেশের লোকের মতো লম্বা পোশাক ডিশডাশা পরিধান করেন এবং মাথায় সাদা টুপি পরেন। তার কক্ষে কম্পিউটারের ওপরে ঊনবিংশ শতকের কারুকাজ করা দেয়াল ঘড়ির  

হাসান ও শাবানা কিউবার ছোট কিন্তু দ্রুত বর্ধমান ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য।
প্রধানত ক্যাথলিকপন্থী খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশ কিউবা সরকারিভাবে সেকুলার রাষ্ট্র। দেশটিতে মাত্র কয়েক হাজার মুসলমান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের বড় অংশ বিদেশী শ্রমিক অথবা শিক্ষার্থী। ইসলাম গ্রহণকারী হাজী ঈশা বলেন, তাদের দেশে প্রায় এক হাজার কিউবান মুসলমান রয়েছেন। এরা ইসলাম গ্রহণকারী অথবা মুসলিম অভিবাসীদের সন্তান। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল জর্জ ইলিয়াস গিল ভিয়ান্ট। তিনি একজন শিল্পী ও হাভানাভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আরব-কিউবা ইউনিয়নের সাবেক গ্রন্থগার।

হাজী ঈশা বলেন, ‘এরা হলো নবীন সম্প্রদায়। বিদেশী মুসলমানরা এখনো কিউবান সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও সৃজনশীলতার নির্ধারণী ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৯০-এর দশকে আফ্রিকা, পশ্চিম সাহারা, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন ও অন্যান্য আরব দেশের মুসলমান ছাত্রছাত্রী এবং পরে পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরা কিউবায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন।

ঈশার মতে, এই দ্বীপ দেশটির ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের নানা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কিউবানদের অনুসৃত ধর্ম হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা ও আগ্রহ এরা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে হাসানের মতো মুসলমানরা অধিকসংখ্যক কিউবানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার পাশাপাশি তাদের সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করছেন। ঈশা বলেন, ‘এটি মুসলমানদের জন্য একটি নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেছে যা অর্থনৈতিকভাবে তাদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে এবং মুসলিম ভাইদের সাহায্যে আসছে।
 
হাসানের ইসলাম গ্রহণ ছিল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তিনি ধর্মহীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং কোনো ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, ‘আমি কিউবার ব্যবস্থায় বড় হয়েছি এবং কখনো গির্জায় যায়নি।’

সান্তা কারার ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের অডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত গিল ভিয়ান্ট আনন্দ-উল্লাসে মাতোয়ারা পার্টিতে যাতায়াত করতেন। ২০১০ সালের রমজান মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তারিপড়–য়া একদল পাকিস্তানি ছাত্রের সাথে অডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করার সময় সব কিছু পাল্টে যায়।

২০০৫ সালে আজাদ কাশ্মিরে ভূমিকম্পে ৮৬ হাজার মানুষ নিহত ও ২৫ লাখ গৃহহীন হয়। এ ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে কিউবা দেশটির উপদ্রুত এলাকায় চিকিৎসাসেবা দিতে দুই হাজারেরও বেশি ডাক্তার ও মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ পাঠায়। পরের বছর কিউবা পাকিস্তানের ১০০০ ছাত্রকে মেডিক্যাল পড়ার বৃত্তি প্রদান করে। এদের প্রায় তিন শ’ জনকে হাসান যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সেখানে ভর্তি করা হয়।

প্রথম দিকে হাসান তাদের এড়িয়ে চলতেন। তিনি বলেন, ‘লোকেরা মুসলমানদের খারাপ চোখে দেখে এবং তাদের সন্ত্রাসীর মতো নানা খারাপ নামে ডাকে।” এ সময় তাকে এসব ছাত্রের অডিও প্রয়োজন দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়। ফলে তাকে তাদের সাথে বেলা ২টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত থাকতে হতো। স্মৃতিচারণ করে হাসিমুখে তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করত। আমি ভয় পেতাম এ কারণে তাদের ওপর আমার রাগও ছিল। তারা আমাকে ইফতার খাবার দাওয়াত দিত কিন্তু আমি তা গ্রহণ করতাম না। তাদের সাথে একত্রে খাওয়া আমার পছন্দ হতো না।’

তৃতীয় দিনের কথা আমার মনে পড়ে। তারা সবাই নামাজ পড়ছিল। আমি নিজেকে তখন প্রশ্ন করি, এ পৃথিবীতে আমি করছি? আমি যেন আমার নিজের আনন্দের জগৎ থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। এরপর একদিন আমি তাদের সাথে খেতে সম্মত হই। তাদের সাথে কথা বলতে শুরু করি। দেখতে পেলাম তারা কিউবায় তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য অব্যাহতভাবে ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করছে।

আমি নিজে জিজ্ঞেস করি, “ওরা যদি এতটা খারাপই হবে তাহলে আমার সাথে এত ভালো আচরণ করছে কিভাবে?’ আমি তাদের সাথে আরো আলাপ করি এবং উপলব্ধি করতে পারি যে, ইসলাম সম্পর্কে কিউবানরা যা বলে আদতে ইসলাম তার থেকে ভিন্ন।

রমজান শেষ হলে তিনি তার নিয়মিত চাকরি শুরু করেন কিন্তু তখনো দেখতে পেলেন যে, ছাত্ররা কুরআন তেলওয়াত করছে এবং নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা করছে। সাত মাস পর আমি ইসলাম গ্রহণ করে নিজের নাম পরিবর্তন করি।
হাসান এক গাল হেসে বললেন, তাদের আচরণ থেকে আল্লাহই আমাকে তাঁর পথ দেখিয়েছেন। ইসলাম শান্তি। এই শান্তি চান আল্লাহ। আল্লাহ আমাকে তা উপলব্ধি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটি আমার জন্য আল্লাহর উপহার।

হাসানের ইসলাম গ্রহণ তার বর্ধিত পরিবারের জন্য প্রথম দিকে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। ইসলাম সম্পর্কে তাদের সুধারণা ছিল না। আমার স্ত্রীও প্রথম দিকে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ইসলামে নারী নির্যাতনের কারণে আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাইনি। কিন্তু আমি অনেক পড়ালেখা করি। এবং স্বামীর ইসলাম গ্রহণের পাঁচ মাস পর আমি ইসলামে দীক্ষিত হই। নাম পরিবর্তন করে শাবানা রাখি।’ তাদের দুই সন্তান, মেয়ে আইনা (১৬) ও ছেলে ইসমাইল(১২)। তারা স্কার্ফ ও ডিশডাশা পরে।-আল জাজিরা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে