সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:১২:০০

তিনটি প্রধান কারণে আল কোরআনের শানে নুজুল জানা একান্ত প্রয়োজন

তিনটি প্রধান কারণে আল কোরআনের শানে নুজুল জানা একান্ত প্রয়োজন

ইসলাম ডেস্ক: অনেক সময় অনেক বুদ্ধিমান লোকও মনে করেন যে, শানে নুজুল জানার কি কোন প্রয়োজন আছে? যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, কুরআনে কারীম স্বয়ং একখানা প্রাঞ্জল ও সাবলীল গ্রন্থ। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জানার জন্য আবার শানে নুজুলের দরকার কি? তাদের এ ধারণা নিতান্তই অমূলক ও ভিত্তিহীন। বস্তুতঃ ইলমে তাফসীরের জন্য শানে নুজুল জানা অপরিহার্য। এর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারীতা অপরিসীম।

১. আল্লামা যরকাশী [রহ.]-এর মতে প্রথমতঃ শানে নুজুলের মাধ্যমে শরঈ বিধানের কারণ জানা যায়। আল্লাহ তাআলা কোন অবস্থায় কোন প্রেক্ষিতে কি বিধান নাযিল করেছেন, তা বোঝা যায়। যেমন, আল্লাহর বাণী- হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাযের কাছে যেও না। (সূরা নিসা- ৪৭৩)

সুতরাং এখানে শানে নুজুল না জানলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে যে, কুরআনে কারীমের দৃষ্টিতে মদ হারাম। তদুপরি মাতাল অবস্থায় তোমরা নামায পড়ো না বলার প্রয়োজন কি? বস্তুত এ আয়াতের শানে নুজুলই উক্ত প্রশ্নের সমাধান দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী [রা.] বলেন, মদ হারাম হওয়ার পূর্বে হযরত আব্দুর রহমান ইবন আউফ [রা.] একদিন সাহাবায়ে কিরামকে খানার দাওয়াত দেন। সেখানে খাবার শেষে শরাবেরও ব্যবস্থা করা হয়। যথারীতি খানা খেয়ে সাহাবায়ে কিরাম শরাব পান করেন। এমতাবস্থায় নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যায়। জনৈক সাহাবী উক্ত নামাযের ইমামতি করেন। মাত্রাতিরিক্ত শরাব পানে তিনি নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তিনি নামাযে কিরাত ভুল করে বসেন। তখন উক্ত আয়াতে কারীমা নাযিল হয়। (ইবনে কাছীর)

২. শানে নুজুল জানা থাকলে আয়াতে কারীমার সঠিক মর্মোদ্ধার করা এবং প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা যায়। নতুবা বিভ্রান্ত হতে হয়। যেমন, পূর্ব-পশ্চিম আল্লাহ তাআলারই। সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও, সে দিকেই আল্লাহর মুখ রয়েছে। (সূরা বাকারা)- ১১৫)

সুতরাং এক্ষেত্রে শানে নুজুল জানা থাকলে প্রশ্ন জাগবে, পূর্ব-পশ্চিম সবদিকেই যখন আল্লাহ আছেন, তখন নামাযে কিবলামুখী হওয়ার প্রয়োজন কি? এতা একটি অহেতুক কাজ। অথচ চরম এক বিভ্রান্তি। স্বয়ং অপর একটি আয়াতে কারীমায় কিবলামুখী হওয়ার পরিষ্কার নির্দেশ জারী হয়েছে। কাজেই এখানে শানে নুজুলের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস [রা.] বলেন- বাইতুল মুকাদ্দাসের বদলে কাবাশরীফ মুসলমানদের কিবলা নির্ধারিত হয়ে ইয়াহূদীরা প্রশ্ন করল, এ পরিবর্তনের কারণ কি? এরই জবাবে উক্ত আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হয়। বলা হয়, সবদিকের স্রষ্টাই আল্লাহ তাআলা। তিনি সদা সর্বত্র বিরাজমান। কাজেই তার (আল্লাহর) নির্দেশ মত কিবলা মানা তথা তার নির্দেশিত দিকে মুখ করা ফরয।

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- যারা ঈমান রাখে ও সৎ কাজ করে, তারা যা কিছু পানাহার করে তাতে দোষের কিছু নেই। কেননা তারা মুত্তাকী এবং ঈমানদার। (সূরা মায়েদা-৯৩)

এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দেখে মনে হয়, মুসলমানদের জন্য সবকিছু আহার করা হালাল। কোন কিছুই হারাম নয়। অন্তরে ঈমান ও আল্লাহর ভয় থাকলে এবং সৎকাজ করলেই হল। সে যথেচ্ছা পানাহার করতে পাবে। অধিকন্তু আয়াতে কারীমাটি মদ হারাম ঘোষণার পরপর আসায় কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এখানে বোধ হয় ঈমানদার ও নেককার লোকদের জন্য মদ্যপানের বৈধতা ও অনুমতি দেওয়া হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)। কতিপয় সাহাবায়ে কিরামও এমন ভুল বুঝে ছিলেন। এমনকি তাঁরা আয়াতে কারীমাটিকে প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হযরত উমর [রা.]-এর দরবারে দাবী উঠান, মদ্যপ ব্যক্তি যদি অতীত জীবনে নেককার থেকে থাকে এবং তার জীবনের সিংহভাগ নেককাজে ব্যয়িত হয়, তাহলে তার উপর দ- নেই। তখন হযরত ইবনে আব্বাস [রা.] উক্ত আয়াতের শানে নুজুল উল্লেখ করে তাদের বিভ্রান্তি নিরসন করেন। (কুরতুবী : ৬/২৯৪)

তদ্রুপ আল্লাহ তাআলা আরও বলেন- নিঃসন্দেহে সাফা-মারওয়া আল্লাহ তাআলার একটি নিদর্শন। সুতরাং যে, কেউ বাইতুল্লাহর হজ্জ্ব করবে কিংবা উমরা করবে, এদুটি প্রদক্ষিণ করায় তার কোন দোষ নেই। (সূরা বাকারা- ১৫৮)

উক্ত আয়াতে কারীমায় বর্ণিত- (আরবী) (তার কোন দোষনেই) অংশ দ্বারা বাহ্যতঃ মনে হয়, হজ্জ্ব বা উমরার সময় সাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণ করা ফরয-ওয়াজিব কিছু নয়। হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর [রা.]-এর ধারণাও তাই ছিল। পরবর্তীতে মা আয়েশা [রা.] তাঁকে বাস্তবতা জানিয়ে দেন। বস্ততঃ ইসলামপূর্ব যুগে উক্ত পাহাড় দুটিতে দুটি মূর্তি স্থাপিত ছিল। একটির নাম আসিফ অপরটির নাম নায়লা। ফলে সাহাবায়ে কিরামের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে, ঐ মূর্তি দুটির কারণে হয়ত সাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণ করা এখন হারাম ও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তখন উক্ত আয়াতে কারীমা নাযিল হয় এবং তাদের সন্দেহ নিরসন হয়। ( মানাহাল : ১/১০৪)

এছাড়া আরও বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে শানে নুজুল ছাড়া আয়াতে কারীমার সঠিক, মর্মোদ্ধার করা দুরূহ ব্যাপার। উপরে নমুনামাত্র কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল।

৩. কুরআনে কারীমের কোথাও কোথাও এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যা শানে নুজুলের সাথে সূক্ষ্মভাবে সম্পৃক্ত। সেক্ষেত্রে শানে নুজুল না জানা থাকলে সেসব শব্দাবলি অহেতুক ও সম্পর্কহীন মনে হয় (নাউযুবিল্লাহ)। ফলে কুরআনে কারীমের সাবলীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন, তোমাদের মধ্যে যেসব মহিলা হায়েয থেকে নিরাশ হয়ে গেছে, (তাদের ব্যাপারে) যদি তোমাদের সংশয় জাগে, তবে তাদের ইদ্দত হবে মাস। তদ্রুপ যেসব মেয়ের এখনও হায়েয আসেনি (তাদেরও এ বিধান)। (সূরা তালাক- ৪)

এ আয়াতে কারীমায় (আরবী) যদি তোমাদের সংশয় জাগে অংশটি বাহ্যতঃ অহেতুক ও সম্পর্কহীন মনে হয়। এর কোন তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না। অধিকন্তু এক্ষেত্রে স্থূলদর্শী বহু লোকই বলে ফেলেন, যে বৃদ্ধা মহিলার হায়েয আসে না, তার গর্ভ নিয়ে সংশয় না হলে তার কোন ইদ্দত পালন করতে হবেনা। অথচ বাস্তবতা এর বিপরীত। তাতে জানা যায়, হযরত উবাই ইবনে কাব [রা.] বলেন, সূরা নিসাতে মহিলাদের ইদ্দত বর্ণিত হলে পরে আমি নবীজীকে প্রশ্ন করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কুরআনে কারীমে কিছু মহিলাদের ইদ্দতের কথা বর্ণিত হয়নি। প্রথমতঃ ছোট ছোট বালিকা, যাদের এখনও হায়েয হয়নি। দ্বিতীয়তঃ বৃদ্ধ মহিলারা, যাদের হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে। তৃতীয়তঃ গর্ভবতী মহিলারা। তখন এ আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হয়, যাতে উপরিউক্ত তিন শ্রেণীর মহিলারই ইদ্দতের কথা বিবৃত হয়েছে।

তদ্রুপ অন্যত্র বিবৃত হয়েছে, অতঃপর তোমরা যখন হজ্জ্বর কাজগুলো সম্পন্ন করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ করবে, যেভাবে তোমরা তোমাদের পূর্ব-পুরুষদের স্মরণ কর। (সূরা বাকারা- ২০০)

অনুরুপভাবে এ আয়াতে কারীমায় (আরবী) যেভাবে তোমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ কর অংশটুকু বাহ্যতঃ সম্পর্কহীন মনে হয়। কারণ, হজ্জ্বের মত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আল্লাহর সাথে পূর্বপুরুষদের স্মরণের সাদৃশ্যতা বোধগম্য নয়। কিন্তু শানে নুজুল জানলে বিষয়টি নিতান্ত যথার্থ মনে হবে।

বস্তুতঃ এখানে মুযদালিফায় অবস্থানের কথা বর্ণিত হয়েছে। আরবের মুশরিকরা হজ্জ্বের রোকনগুলো আদায় করার পর যথারীতি এখানে এসে তাদের পূর্বপুরুষদের গৌরব গাঁথা ও গুণগানে বড়ই আবেগাপ্লুত ও উচ্ছসিত। কাজেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক্ষণে তাঁদেরকে নির্দেশ দেন। (আসবাবুন্ নুজুল- আল্লামা ওয়াহেদীঃ ৩৪)

এছাড়াও কুরআনে কারীমের বহু স্থানে সংক্ষিপ্তাকারে বিশেষ কোন ঘটনার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। উক্ত ঘটনা না জানলে সেসব আয়াতে কারীমার মর্মার্থ আদৌ বোঝা যায় না। যেমন, ইরশাদ হয়েছে- আর যখন আপনি (মুঠি ভরা ধুলি) নিক্ষেপ করলেন, তখন তা আপনি নিক্ষেপ করেননি বরং আল্লাহ তাআলা নিক্ষেপ করেছেন। (সূরা আনফাল- ১৭)

এ আয়াতে কারীমায় বদর যুদ্ধের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ [সা.] কাফিরদের প্রতি এক মুঠো মাটি নিক্ষেপ করেছিলেন। ফলে কাফিররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। বস্তুতঃ এ শানে নুজুল না জানা হলে আয়াতে কারীমাটির মর্মার্থ কি- আগাগোড়া কিছুই বোঝা যেত না।
১২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে