আফতাব চৌধুরী: ইসলামে জ্ঞানবিজ্ঞানের মান-মর্যাদায় অনুপ্রাণিত হয়ে মধ্যযুগের মুসলমানরা আপন হৃদয়ের জ্ঞানরূপ আলোকবর্তিকা দিয়ে পৃথিবীর সব জ্ঞানভান্ডার আহরণ করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। মুসলিম বৈজ্ঞানিকরা লোহাকে সোনা করার অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যদিও তা সম্ভব হয়নি তথাপি এ গবেষণা সূত্রপাত করল নব উপাদান আবিষ্কারের। খলিফা মনসুর, হারুন আল রশিদ, মামুন, মালিক শাহ প্রমুখের সময় জ্ঞানবিজ্ঞানের এহেন সাধনা চরমে পৌঁছেছিল। বাগদাদ, মিসর, মরক্কো, স্পেন, পারস্য, সিসিলি, গ্রানাডা প্রভৃতি স্থান ছিল সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক, বিজ্ঞান, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, সামরিক শিক্ষা, তফসির, হাদিস, ফিকাহ, শিল্পকলা, নৌবিদ্যা, শিল্প বাণিজ্য ইত্যাদি শিক্ষা লাভের প্রাণকেন্দ্র। সংক্ষেপে বলতে গেলে ইউরোপে যখন জ্ঞানের আলো পৌঁছেনি তখনও আরববাসী জ্ঞানবিজ্ঞানে ছিলেন অনেক পারদর্শী।
রাসায়নিক শাস্ত্রকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং প্রাচীন লোকের ভ্রান্ত ধারণা থেকে উদ্ধার করে পরিপূর্ণ বিজ্ঞান হিসেবে উন্নত করতে মুসলিম বৈজ্ঞানিক জাবির ইবনে হাইয়ানের অভূতপূর্ব অবদান। জার্মান পন্ডিত j Ruska, Paul Kraus, ইংল্যান্ডের E j Holnyard এবং আমেরিকার G Sarton স্বীকার করেন যে, জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসায়নিক। ইবনে নাদিমের মতে জাবির (Geber) ২ হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন; তার মধ্যে রয়েছে ২৬৭ খানা গ্রন্থ রসায়নশাস্ত্র নিয়ে রচিত। জাবির কুফায় একটি Laboratory স্থাপন করেন, তার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অসাধারণ কৃতিত্বে সৃষ্টি হয় কিমিয়া বা ক্যামেস্ট্রি।
মধ্যযুগে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গভীর সাধনা করেন ইবনে সিনা, ইবনে জাহর, আল জাহরাওয়ি, উবায়দুল্লা জেব্রিল, আলী ইবনে সহল রব্বান আল-তাবায়ি, আল রাজি, আলি বিন-আব্বাস ও আল মজসি। চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে ইবনে সিনার লিখিত গ্রস্থ ‘আল কানুন’কে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়।
আরববাসীর মধ্যে গণিতশাস্ত্রে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন খারিজমি ও ইবনে মুল্লাহ। খারিজমির লিখিত ‘হিসাবুল জবর ওয়াল মুকাবল’ গ্রন্থটি সর্বপ্রথম বীজগণিতের পাঠ্যপুস্তকরূপে সমাদৃত হয়। পৃথিবী যে গোল তাও তিনি ১১৮৬ সালে তার রচিত ‘সুরাত আল আরদ’ নামক গ্রন্থ দ্বারা প্রমাণ করে দেখান। তাছাড়া ইবনে মুসা একাধারে গণিতবিদ, ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ ও দার্শনিক ছিলেন। ৮৫০ সালে তিনিই প্রথম মানচিত্রের ব্যবহার দেখান।
নৌসংক্রান্ত কম্পাস আবিষ্কার করে মধ্য যুগের মুসলমানরা সমুদ্রযাত্রা করে বিভিন্ন দেশ আবিষ্কার করেন। আবদুর রহমান, জায়হানি, আল ইদ্রিসি, আল বকরি, আল মামুদি, ইবন হাওকল, আল মুকদ্দসি প্রমুখ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভূগোলজ্ঞ ছিলেন। আরব নাবিক আবদুর রহমানের নির্দেশনায় কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। ১৫১৩ সালে নায়ক পিরি রইস দূরত্ব ও কম্পাস নির্দেশনার মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা উপকূল হরিণের চামড়ার ওপর অঙ্কন করেন। তিনি নৌবিজ্ঞান, আটলান্টিক মহাসাগর ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগর নিয়ে অতি মূল্যবান কয়েক খানা গ্রন্থ রচনা করেন। বৈজ্ঞানিক আবদুর হাসান টিউব থেকে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ ও ইবনে বয়তার মুসলিম স্পেনে উদ্ভিদবিদ্যায় অসাধারণ পা-িত্য দেখিয়েছিলেন।
আল মাজিরিত, আল জারকালি ইবনে আফলাহ মোহাম্মদ বিন ইব্রাহিম ও আল ফাজারি সে যুগের প্রসিদ্ধ জ্যোর্তিবিদ ছিলেন। ১০৬৮ সালে স্পেনের সঈদ আসসাফি একটি আন্টোলের তৈরি করেন, যার দ্বারা বছরে সূর্যের গতিপথ নির্দেশিত এবং ২৮টি তারকার অবস্থান বোঝা যায়। বর্তমানে এটি অক্সফোর্ডের মিউজিয়াম অব হিস্টি অব সায়েন্সে সুরক্ষিত আছে।
মধ্যযুগে কাব্য ও সাহিত্য সাধনায় অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন ইবনে আবদে রাব্বি, আবু ওয়ালিদ, শেখ সাদি, ইসফাহানি, ইবনে খালিকান, ফেরদৌসী, আবু নেওয়াজ, আলবুহতারি, দাকিকি, জালাল উদ্দিন রুমি ও মোহাম্মদ বিন ইসহাক। সাদীর গুলি , বুস্তা এবং ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ গ্রন্থ পৃথিবীতে বিরল। মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ হামাদান, মাসুদি, তাবারি আব্বাসি যুগে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে আল কাতিব, ইবনে খালদুন আবু উবায়দুল্লাহ, আবু মারওয়ান, আলি ইবনে হাজম স্পেনের সমুন্নত ঐতিহাসিক ছিলেন। ইবন হাজন ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, হাদিস, তর্কশাস্ত্র ও কবিতা নিয়ে ৪০০ অধ্যায়ের গ্রন্থ রচনা করেন।
মুসলিম মনীষীদের মধ্যে ওমর খৈয়ামের দান অতুলনীয়। তিনি গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। আরববাসীর মধ্যে দর্শন নিয়ে গভীর সাধনা করে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন ইমাম গাজালি, আল ফারাবি, ইবনে সিনা এবং আলকিন্দি। মালিক শাহ নিজামুল মুলকের সরকারের নিয়ম কানুন ও কৌশল সংক্রান্ত ‘সিয়াসত নামা’ গ্রন্থটি রাজনীবিদদের পথ প্রদর্শনস্বরূপ।
খলিফা মনসুর পৃথিবীর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর আরবি ভাষায় অনুবাদ বিভাগ স্থাপন করেন। খলিফা হারুন ও মামুনের সময় তা আশাতীত প্রসার লাভ করে। মামুন লুকের ছেলে কাতাকে আর্কিমিডিস, ইউক্লিড, অ্যারিস্টটল, প্লেটো, গ্যালন প্রমুখ গ্রিক মনীষীদের গ্রন্থাবলি অনুবাদের পদে নিযুক্ত করেন।
পন্ডিত হোসাইনকে বিদেশি বিজ্ঞানের গ্রন্থাবলি, আহয়া নামক পারসিককে ফারসি গ্রন্থাবলি এবং ভারতের ব্রাহ্মণ দুবানকে সংস্কৃত ভাষায় মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদের জন্য নিয়োগ করেছিলেন। তিনি ‘বায়াতুল হিকমা’ বাগদাদে স্থাপন করে ন। প্রসিদ্ধ জ্যোর্তিবিদ মোহাম্মদ-বিন-ইব্রাহিম আল ফাজারি খলিফা মামুনের অনুরোধে ভারতীয় জ্যোর্তিবিদ্যার ‘সিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন।
৭১২ সালে আরবরা যখন ভারতের সিন্ধু মুলতান ও পাঞ্জাব জয় করে তখন থেকে আরব জাতি ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আলবেরুনি মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় পান্ডিত্য লাভ করে আরবি ভাষায় সংস্কৃতের অনেক নীতিমূলক গল্প ও তত্ত্ব তুলে ধরেন। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতাও এক্ষেত্রে ভারতের মান-মর্যাদা পৃথিবীর মানুষের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। তাছাড়া আলবেরুনি ‘আল-হিন্দ’ গ্রন্থটি বিশ্বে আলবেরুনির ইন্ডিয়া নামে পরিচয় লাভ করে। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, ভূগোল, ইতিহাস নিয়ে গভীর সাধনা করেন আলবেরুনি।-আলোকিত বাংলাদেশ
১৪ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ