ইসলাম ডেস্ক: পবিত্র কুরআনের ৬ নম্বর সূরা এটি। সূরা আনআমের আয়াত সংখ্যা ১৬৫টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ২০টি। এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরাতে আল্লাহর একত্ববাদ, পূণরুত্থান, জান্নাত এবং জাহান্নাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
নামকরণ:
এ সূরারা ১৬ ও ১৭ রুকূতে কোন কোন আন’আমের (গৃহপালিত পশু) হারাম হওয়া এবং কোন কোনটির হালাল হওয়া সম্পর্কিত আরববাসিদের কাল্পনিক ও কুসংস্কারমূলক ধারণা বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে এ সূরাকে আল আন’আম নামকরণ করা হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল:
ইবনে আব্বাসের বর্ণনা মতে এ সম্পূর্ণ সূরাটি একই সাথে মক্কায় নাযিল হয়েছিল। হযরত মূআয ইবনে জাবালের চাচাত বোন হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটনীর পিঠে সওয়ার থাকা অবস্থায় এ সূরাটি নাযিল হতে থাকে। তখন আমি তাঁর উটনীর লাগাম ধরে ছিলাম। বোঝার ভারে উটনীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যেন মনে হচ্ছিল এই বুঝি তার হাড়গোড় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। হাদীসে একথাও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে, যে রাতে এ সূরাটি নাযিল হয় সে রাতেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিকে লিপিবদ্ধ করান।
এর বিষয় বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে সুস্পষ্টভাবে মনে হয়, এ সূরাটি মক্কী যুগের শেষের দিকে নাযিল হয়ে থাকবে। হযরত আসমা বিনতে ইয়াযিদের রেওয়াতটিও একথার সত্যতা প্রমাণ করে। কারণ তিনি ছিলেন আনসারদের অন্তরভুক্ত। হিজরতের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। যদি ইসলাম গ্রহণ করার আগে তিনি নিছক ভক্তি-শ্রদ্ধার কারণে মক্কায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে হয়ে থাকবেন তাঁর মক্কায় অবস্থানের শেষ বছরে। এর আগে ইয়াসরেববাসীদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত বেশী ঘনিষ্ঠ হয়নি যার ফলে তাদের একটি মহিলা তার খেদমতে হাযির হয়ে যেতে পারে।
"সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য যিনি নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং অন্ধকার ও আলো সৃষ্টি করেছেন। তবুও কাফেররা নিজ পালনকর্তার সাথে অন্যান্যকে সমতুল্য স্থির করে।"
الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِم يَعْدِلُونَ
সুরা আনআ'মের প্রথম আয়াতের অর্থ শুনলেন। এই আয়াতের মাধ্যমে তিন ধরনের কাফিরদের অবাস্তব ধারণাগুলো প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে: প্রথমত যারা মনে করে কোনো জিনিসেরই স্রস্টা নেই, সব কিছুই নিজ থেকেই সৃষ্ট। এরা হল নাস্তিক। দ্বিতীয়ত যারা মনে করে অন্ধকার ও আলোই হচ্ছে সব কিছুর স্রস্টা। তৃতীয়ত অংশীবাদীদের দল যারা মনে করে মূর্তিগুলো আল্লাহর অংশীদার বা শরিক।
পুরো সুরা আনআ'ম পবিত্র কাবা ঘরের কাছে বিশ্বনবী (সা.)'র কাছে এক বারেই নাজিল হয়েছিল। এর সঙ্গে একই সময় মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে ৭০ হাজার ফেরেশতাও নাজিল হয়েছিল।
অহংকার ও স্বার্থপরতাই হচ্ছে মূর্তি পূজা বা শিরকের উৎস। মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে মুশরিকদের সতর্ক করে দিয়ে এই সুরার পঞ্চম আয়াতে বলছেন:
أَلَمْ يَرَوْاْ كَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَبْلِهِم مِّن قَرْنٍ مَّكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّن لَّكُمْ وَأَرْسَلْنَا السَّمَاء عَلَيْهِم مِّدْرَارًا وَجَعَلْنَا الأَنْهَارَ تَجْرِي مِن تَحْتِهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَأَنْشَأْنَا مِن بَعْدِهِمْ قَرْنًا آخَرِينَ
"তারা কি দেখেনি যে, আমি তাদের আগে কত সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে এমন প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলাম, যা তোমাদেরকে দেইনি। আমি আকাশকে তাদের উপর অনবরত বৃষ্টি বর্ষণ করতে দিয়েছি এবং তাদের তলদেশে নদী সৃষ্টি করে দিয়েছি, অতঃপর আমি তাদেরকে তাদের পাপের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং তাদের পরে অন্য সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছি।"
খোদাদ্রোহীদের ও সত্য অস্বীকারকারীদের পরিণতি কি হয়েছে তা দেখার জন্য মহান আল্লাহ মানুষকে ভ্রমণ করার ও এ নিয়ে চিন্তাভাবনার পরামর্শ দিয়েছেন।
সুরা আনআ'মের ১১ নম্বর আয়াতে মহানবী (সা.)-কে আল্লাহ বলছেন:
قُلْ سِيرُواْ فِي الأَرْضِ ثُمَّ انظُرُواْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
"বলে দিন: তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর, অতঃপর দেখ, মিথ্যারোপকারীদের তথা আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকারকারীদের পরিণাম কি হয়েছে?"
অতীতের জাতিগুলোর নানা নিদর্শন দেখার মাধ্যমে মানুষ সত্যকে ভালোভাবে বুঝতে পারে।
এই সুরার নাম আনআ'ম রাখার কারণ হল, এতে চতুষ্পদ জন্তু ও গৃহপালিত পশু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এ সুরার ১৩৭ নম্বর আয়াত থেকে ১৪৫ নম্বর আয়াতে চতুষ্পদ জন্তু ও গৃহপালিত পশু সম্পর্কে কাফিরদের নানা ভুল ধারণা এবং কুসংস্কারের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
মহান আল্লাহ এই আয়াতগুলোতে বলেছেন:
"আল্লাহ যেসব শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো থেকে তারা এক অংশ আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে; এরপর নিজ ধারণা অনুসারে বলে এটা আল্লাহর এবং এটা আমাদের অংশীদারদের। এরপর যে অংশ তাদের অংশীদারদের, তা তো আল্লাহর দিকে পৌঁছে না এবং যা আল্লাহর তা তাদের উপাস্যদের দিকে পৌঁছে যায়। তাদের বিচার কতই না মন্দ।"
মহান আল্লাহ আরো বলছেন:
"এমনিভাবে অনেক মুশরেকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের ধর্মমতকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করত না। অতএব, আপনি তাদেরকে এবং তাদের মনগড়া বুলিকে পরিত্যাগ করুন। তারা বলে: এসব চতুষ্পদ জন্তু ও শস্যক্ষেত্র নিষিদ্ধ। আমরা যাকে ইচ্ছা করি, সে ছাড়া এগুলো কেউ খেতে পারবে না, তাদের ধারণা অনুসারে। আর কিছুসংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে আরোহন হারাম করা হয়েছে এবং কিছু সংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর উপর তারা ভ্রান্ত ধারনা বশত: আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না, তাদের মনগড়া বুলির কারণে, অচিরেই তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। তারা বলে: এসব চতুষ্পদ জন্তুর পেটে যা আছে, তা বিশেষ ভাবে আমাদের পুরুষদের জন্যে এবং আমাদের মহিলাদের জন্যে তা হারাম। যদি তা মৃত হয়, তবে তার প্রাপক হিসাবে সবাই সমান। অচিরেই তিনি তাদেরকে তাদের মিথ্যাচারের জন্য শাস্তি দেবেন। তিনি প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী। নিশ্চয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা নিজ সন্তানদেরকে নির্বুদ্ধিতাবশতঃ কোন প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তাদেরকে যেসব দিয়েছিলেন, সেগুলোকে আল্লাহর প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে হারাম করে নিয়েছে। নিশ্চিতই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথগামী হয়নি। "
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/এমআর