শুক্রবার, ০৪ আগস্ট, ২০১৭, ০৯:৪১:৩১

হাজিরা আল্লাহর মেহমান

হাজিরা আল্লাহর মেহমান

হুমায়ুন আইয়ুব : হজ আরবি শব্দ। অর্থ ‘ইচ্ছা’ বা ‘সংকল্প’ করা শরিয়তের পরিভাষায় হজের মাসগুলোতে বিশেষ কিছু কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু স্থানের জিয়ারত করাকে হজ বলে। ইসলামের বর্ণনা অনুসারে ইসলাম ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য হজ একটি ফরজ ইবাদাত। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ।

তবে মহিলাদের জন্য আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য ছাড়াও তৃতীয় একটি শর্ত রয়েছে, সেটি হলো হজে যাওয়ার জন্য তার নিজের স্বামী বা যার সঙ্গে ওই মহিলার বিয়ের অনুমতি নেই এমন মাহরাম ব্যতীত তাদের হজে যাওয়া নিষেধ। মাহরাম ব্যতীত এমন মহিলার সাথে হজের সফর সহিহ হয় না। কারণ, নারীদের সফরে মাহরাম পুরুষের আবশ্যকতা ঘোষণা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো নারী যেন এক দিন এক রাতের পথভ্রমন কোনো মাহরাম ছাড়া না করে (বুখারি ও মুসলিম)। তবে এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো, যদি কোনো মহিলা মাহরাম ব্যতীত হজ করতে যায় তাহলে হজ হয়ে যাবে, কিন্তু মাহরাম ব্যতীত হজের সফরের জন্য গোনাহগার হবে।

হজ ইসলামের ৫ম স্তম্ভ। আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধারিত সময়। অন্য সময় হলে সেটি ইসলামের পরিভাষায় ওমরা বলে। হজ পালনের জন্য বর্তমান সৌদীআরবের মক্কা নগরী এবং সন্নিহিত মিনা, আরাফাত, মুযদালাফা প্রভৃতি স্থানে গমন ও অবস্থান আবশ্যক। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমাবেশ মূলত ইবাদাত। হজের নিয়মানুযায়ী বছরের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পোশাকে কয়েকটি স্থানে উকুফ, কাবা শরিফের তাওয়াফ, পশু কোরবানী ও নির্দিষ্ট স্থানে পরপর ৩দিন কংকর নিক্ষেপ এবং সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দ্রুত গতিতে হাঁটা হলো হজ পালনের আবশ্যিক বিধান। যিনি হজ পালনের জন্য গমন করেন তাঁকে বলা হয় হাজি।

কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেন হযরত আদম আ.। তারপর হযরত নূহ আ. সহ অন্য নবী-রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করেন। হযরত ইবরাহিম আ. এর সময় থেকে হজ ফরজ ইবাদত হিসেবে বিধিত হয়। হিজরি সনের জিলহজ মাসে মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহিম আ. এর প্রতি হজ ফরজ করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের মাঝে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশবায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে।’ (সূরা হজ : ২৭) কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, এ আদেশের পর ইবরাহিম আ. পাহাড়ে উঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘হে লোক সকল, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো’।

হজের অনেক আচার অনুষ্ঠান ও নিয়মনীতি হযরত ইবরাহিম আ. এর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্ণিত আছে, ইবরাহিম আ. আল্লাহর নির্দেশে তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরাকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। সেখানে কাবা শরিফের অদূরে, বিবি হাজেরা নবজাতক শিশু ইসমাইল আ. কে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলেন। সাহায্যের জন্য কাউকে না পেয়ে তিনি পানির খোঁজে সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছিলেন। এ ঘটনাকে স্মরণ করেই হজের সময় মুসলিমদের জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে দ্রæতপদ হাঁটার নিয়ম সূচিত হয়। এছাড়াও বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা বেহেশত থেকে হযরত আদম ও হাওয়া আ. কে যখন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, এতে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে উভয়ে আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হন। এ ঘটনার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হজের একটি অংশ হিসেবে হাজীরা আরাফাতের ময়দানে এসে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে ইবাদতে মগ্ন হন। হজের আরেকটি অপরিহার্য অংশ হলো তাওয়াফ। কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব থেকে শুরু করে একাদিক্রমে ৭বার কাবা শরিফ প্রদক্ষিণ করাকে ইসলামে তাওয়াফ বলা হয়ে থাকে।
হজ ফরজ হওয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরা পূর্ণ করো। (সূরা বাকারা : ১৯৬) হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সস্তুষ্টির জন্য হজ পালন কলে এবং অন্যায় ও গোনাহের কাজ করল না, সে বাড়ি প্রত্যাবর্তনকালে এমন নিষ্পাশ হয়ে ফিরল যেন সে এই মাত্র তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হলো (বুখারি ও মুসলিম) অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, হাজীরাও হজ পালনের পর বেকসুর বা পাপমুক্ত হয়ে যায়। এ হাজীদের কাছে দোয়া চাওয়ার জন্য আদেশ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো হাজীর সাক্ষাত পাবে তখন তাকে সালাম দিবে, মুসাফাহা করবে এবং তিনি তার গৃহে প্রবেশ করার পূর্বে তোমার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে অনুরোধ করবে। কেননা, হাজীরা হলেন ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তি।’ (মিশকাত : ২০৩৯)

অন্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শয়তান আরাফার দিন হতে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না। কারণ, সেদিন আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করেন এবং অসংখ্য কবিরা গোনাহ মাফ করে দেন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘একটি মকবুল হজ গোটা পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর চেয়ে বহুগুণে উত্তম। বেহেশত ছাড়া তার প্রতিদান হতে পারে না।’ (মিশকাত : ২০১০)

হাদিসে এসেছে, তিন প্রকার লোক আল্লাহর যাত্রীদল হয়ে থাকেন গাজী, হাজী ও ওমরাকারী (নাসায়ী, বায়হাকী)। একারণে যারা হজ-ওমরা করতে যান তারা আল্লাহর মেহমান। যারা আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে তারা বড় ভাগ্যবান। কিন্তু অনেক সময় কারো কারো পক্ষে নানা কারণে আরাফা পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হয় না। দেখা গেল এয়ারপোর্টে পৌঁছে কারো মৃত্যু হলো। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে কোরআন শরিফে আছে, তার নিয়ত, তার ইখলাস ও মহব্বতের ওপর, ঈমান ও আমলের ওপর আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন যে ব্যক্তি হজ করার জন্য ঘর থেকে বের হলো, এরপর রাস্তায় তার মৃত্যু হয়ে গেল, আল্লাহ পাক তাকে মকবুল হজের সওয়াব দান করবেন। (বুখারি)

বর্তমানে এয়ারপোর্টে ৪-৫ দিন পড়ে থাকার বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। লোকেরা মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করে। অনেকে মাসয়ালা জানে না। কী করবেন না করবেন বুঝতে পারেন না। ফলে দেখা যায়, তারা এহরাম খুলে ফেলে। এহরাম বাঁধার পর বায়তুল্লাহ শরিফে তাওয়াফ করার আগ পর্যন্ত বাসায় থাকলেও এহরাম অবস্থাতেই থাকতে হবে। এয়ারপোর্টে থাকলেও এহরাম অবস্থায় থাকতে হবে। কেউ যদি এহরাম খুলে ফেলে, তাহলে তার ওপর দম ওয়াজিব হবে। তাকে কোরবানি দিতে হবে এবং এখানে দিলে হবে না, হারাম শরিফে দিতে হবে। এজন্য টেলিফোন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আপনার পক্ষ থেকে কেউ হারাম শরিফের ভেতরে কোরবানি করে আপনাকে জানাবে, তারপর আপনি এহরাম খুলতে পারবেন।

হজরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সুলহে হুদাইবিয়ার সময় মদিনা থেকে এহরাম পরে ওমরার জন্য এসেছিলেন এবং হুদাইবিয়ায় কাফেরদের বাধার সম্মুখীন হয়ে আটকা পড়েছিলেন, তখন উট জবাই করে এহরাম খুলেছিলেন। এটাই মাসয়ালা। হজযাত্রীর মৃত্যু হয়ে গেলেও ওয়ারিশদের উচিত তার পক্ষ থেকে হজ করিয়ে দেওয়া। মৃত্যু হয়ে গেলে হজের সওয়াব তিনি পাবেন, কিন্তু তার ওপর হজ বাকি থেকে যায়, যদি তিনি সম্পদশালী হন, তাহলে সন্তানদের উচিত মৃতব্যক্তির পক্ষ থেকে বাকি হজ সম্পন্ন করে দেওয়া।
এমটিনিউজ২৪ডটকম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে