মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:২৩:৫৪

১৯৭৯ সালে যেভাবে বাইতুল্লাহকে দখলদারীদের থেকে উদ্ধার করা হয়

১৯৭৯ সালে যেভাবে বাইতুল্লাহকে দখলদারীদের থেকে উদ্ধার করা হয়

ইসলাম ডেস্ক : সৌদি আরবের ইতিহাসে সবচেয়ে নাটকীয় এবং অপ্রকাশিত কাহিনীগুলোর একটি হচ্ছে ১৯৭৯ সালের পবিত্র মক্কা অবরোধের ঘটনা। ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা এবং একে ঘিরে তৈরি মসজিদ আল হারাম বা হারাম শরীফ অবরোধ করেছিল একটি সালাফিপন্থী কট্টোর ইসলামি গোষ্ঠী। সেই ঘটনা নিয়ে ‘ইতিহাসের সাক্ষী’ নামে একটি প্রতিবেদন করেছেন বিবিসির এলিমেঙ্কি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর ইসলামি বর্ষপন্থীতে এই দিনটার একটা প্রতীকি তাৎপর্য রয়েছে। একটি নতুন শতাব্দীর শুরু সেদিন হিজরীর ১৪০০ সালের প্রথমদিন। মক্কায় সেদিন হাজার হাজার মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে আসা মুসলিমরা সেদিন ফজরের নামাজে যোগ দেয়ার অপেক্ষায় মসজিদ আল হারাম বা হারাম শরীফে।
ফজরের নামাজ মাত্র শেষ হতে চলেছে হঠাৎ সাদা কাপড় পড়া ২০০ লোক অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এলো নামাজীদের মধ্যে থেকে। কয়েকজন অস্ত্রধারী গিয়ে অবস্থান নিল ইমামের চারপাশে। তারপর তারা মাইকে এমন এক ঘোষণা দিল যা শুনে হতবাক হয়ে গেল সবাই।

এই ছিল সে ঘোষণা, আমরা আজ ইমাম মাহাদীর আর্বিভাব ঘোষণা করছি। তিনি বিশ্বের ন্যায় বিচার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। যে বিশ্ব এখন অন্যায়, অত্যাচার এবং অশান্তিতে ভরে গেছে। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী ইমাম মাহাদী বিশ্বে আর্বিভাব হবে ইসলামকে পুনরূদ্ধার করতে।

সেদিন মক্কায় এই ঘোষণা যারা শুনছিলেন তাদের মধ্যে ছিল একজন মাদ্রাসার ছাত্র। যিনি মাত্র হজ্ব শেষ করেছিলেন। তিনি বলেন, আমরা খুব অবাক হলাম। ফজরের নামাজের পর পরই কিছু লোক হারাম শরীফে মানুষের উদ্দেশে কথা বলার জন্য মাইক্রোফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল।
তারা বলছিল, মাহাদী পৃথিবীতে আবির্ভ‚ত হয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবে মানুষ খুশি হয়েছিল যে যিনি পৃথিবীকে বাঁচাবেন সে ত্রাতা তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন। মানুষ ছিল খুবই উৎফুল্ল। তারা জোড়ে আল্লাহু আকবর বলে ধ্বনি দিচ্ছিল। যে সশস্ত্র গ্রæপটি সেদিন কাবা এবং হারাম শরীফের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল তারা ছিল সালাফীপন্থী একটি কট্টোর সুন্নী গোষ্ঠী। তাদের নেতা ছিলেন এক বেদুইন জুহাইমান আল হুতাইবি।

মসজিদের মাইকে জুহাইমান আল হুতাইবি ঘোষণা দিলেন, ইমাম মাহাদী সেখানে তাদের মাঝে আছেন। তার এ ঘোষণার পর সশস্ত্র গ্রæপটির মধ্যে একজন সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি জুহাইমানের সম্পর্কিত একজন ভাই। তার নাম মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল খাহতানি। জুহাইমান দায়ি করলেন মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল খাহতানি হচ্ছে ইমাম মাহাদী। তারপর জুহাইমান সামনে এগিয়ে আসল এবং ইমাম মাহাদীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করল। সে লোকজনকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলো ইনি হচ্ছেন ইমাম মাহদী। সবাই মাহাদীর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে শুরু করল।
সেদিন ঘটনার সময় মসজিদের ঠিক বাইরে ছিলেন মাদ্রাসার আরেক ছাত্র আবদুল মোনায়েম সুলতান। কি ঘটছে তা জানতে মসজিদের ভিতরে ঢুকলেন। হারাম শরীফের ভিতরে সশস্ত্র লোকজন দেখে লোকে অবাক হয়ে গেল। সেখানে এরকম দৃশ্য দেখতে তারা অভ্যস্ত নয়। কোন সন্দেহ নেই, এই দৃশ্য দেখে সবাই স্তম্বিত হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল খুবই আপত্তিকর একটি ঘটনা। বিদ্রোহীদের নেতা জুহাইমান পবিত্র কাবাকে ঘিরে একটি অবরোধ তৈরির নির্দেশ দিলেন। মসজিদের মিনারগুলোতে বন্দুকধারীদের অবস্থান করার জন্য নির্দেশ দিলেন। যাতে কেউ হামলা করলে তাদের প্রতিরোধ করা যায়। সৌদি পুলিশ বাহিনীর একটি দল প্রথমে এগিয়ে এল কি হচ্ছে দেখার জন্য।

বন্দুকধারীদের দৃষ্টিতে সৌদি শাসকরা গোষ্ঠীরা হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত, নৈতিকভাবে দেউলিয়া এবং পাশ্চাত্যধারা কলুষিত। কাজেই সৌদি পুলিশকে দেখা মাত্র গুলি চালাতে শুরু করল তারা। অনেকেই নিহত হলো। শুরু হলো কাবা ও হারাম শরীফকে ঘিরে এক তীব্র লড়াই।
বন্দুকধারী যে লোক ছিল তাদের হাতে খুব ভালো অস্ত্র ছিল। তারা অনেককেই গুলি করে হত্যা করেছিল। মার্ক হেনরি তখন সৌদি আরবের মার্কিন দূতবাসের একজন পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। একজন মার্কিন হেলিকপ্টারের কাছ থেকে তিনি প্রতি মূহুর্তের খবর নিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, বন্দুকধারীদের মোকাবেলায় প্রথম চেষ্টাটি ছিল খুবই কাঁচা। অল্প সংখ্যক ন্যাশনাল গার্ড ও সামরিক বাহিনীর প্রথম প্রচেষ্টা ছিল বেশ সাহসী। কিন্তু বন্দুকধারীরা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে।

সৌদি সরকার সেখানে হাজার হাজার সৈন্য ও কমান্ডো পাঠালো কাবা পুনরায় দখলের জন্য। কাবা এবং হারাম শরীফের ভিতরে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য সৌদি রাজপরিবার দেশটির ধর্মীয় নেতাদের কাছে অনুমতি চাইলেন। পরবর্তী কয়েকদিনে সেখানে তীব্রলড়াই শুরু হয়ে গেল।
সারারাত গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরদিন পর্যন্ত এমন চলতে লাগল। হারাম শরীফের মিনার লক্ষ্যে করে গুলি ছুড়তে দেখেন তিনি। মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল খাহতানি পুরো ভাগেই ছিলেন। যাদের বন্দুক ফুড়িয়ে যাচ্ছিল তিনি দৌঁড়িয়ে দৌঁড়িয়ে অস্ত্র কুঁড়িয়ে তাদের সংগ্রহ করে দিতে দেখা যায়।
সৌদি আরবের মার্কিন দূতবাসের কর্মকর্তা মার্ক হেনরি বলছিলেন, দিন যত বাড়তে লাগল লড়াই তত তীব্র হতে লাগল। বন্দুকধারীরা তখন মসজিদের ভ‚গর্ভস্থ করিডোরে অবস্থান করল। কথিত ইমাম মাহাদী মারাত্বকভাবে আহত হলেন। কিন্তু তিনি সত্যি ইমাম মাহাদী হন তাহলে এমনটা হওয়া অসম্ভব।
মক্কাকে ঘিরে এই অবরোধ অবসানের জন্য সৌদি প্রধানরা ফরাসী বিশেষজ্ঞের সাথে শলাপরামর্শ করে। তাদেরকে গোপনে পাঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত বন্দুকধারীরা নিজেরাই আত্মসমার্পণ করে।

দুসপ্তাহ ধরে এ অবরোধ চলেছিল। পরে জঙ্গিদের নেতা জুহাইমানসহ ৬৩ জনকে মৃত্যুদÐ দেয়া হয়। শত শত মানুষ এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।- বিবিসি 
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে