ইসলাম ডেস্ক: দুনিয়ার জীবনে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিদের যারা তওবা করবেনা, আল্লাহর রহমত অর্জন করতে ব্যর্থ হবে, তাদের জাহান্নামের শাস্তি কবরের জীবনেই শুরু হয়ে যাবে। এই শাস্তি চলবে কেয়ামত পর্যন্ত, আর জাহান্নামের শাস্তিতো আরো কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী।
এইজন্য রাসুল সাঃ আমাদেরকে বারবার কবরের আযাব থেকে বাঁচার জন্য, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। তিনি নিজেও নামাযের ভেতরে ও বাইরে কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেন। কবরের আযাবের ভয়াবহতা চিন্তা করে সাইয়্যিদিনা উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) কবরের কথা স্মরণ করলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন, এমনকি তাঁর কাপড় ভিজে যেত চোখের পানিতে।কবরের শাস্তি হিসেবে যা থাকবে তার উদাহরণঃ
১. কাজ্জাব বা বড় মিথ্যাবাদী ও মিথ্যা কথা প্রচারকারীর শাস্তিঃ কাজ্জাবকে দাঁড়ানো অবস্থায় এক পাশের চোয়াল এমনভাবে আকড়া দিয়ে বিদ্ধ করা হবে যে, সেটা তার চোয়াল বিদীর্ণ করে মস্তকের পশ্চাদভাগ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তারপর অপর চোয়ালটিকেও একইভাবে বিদীর্ণ করা হবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
২. কোরআন শিখে সে অনুযায়ী আমল না করা এবং বেনামাযীদের শাস্তিঃ ক্বুরানকে অবহেলাকারী ও বেনামাযীকে মাটিতে ফেলে তার মাথার কাছে একজন আজাবের ফেরেশতা দাঁড়িয়ে পাথর দিয়ে আঘাত করে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। নিক্ষিপ্ত পাথর দূরে গড়িয়ে যাওয়ার ফলে তা তুলে নিয়ে শায়িত ব্যক্তির কাছে ফিরে আসার আগেই ভেঙ্গে যাওয়া মাথা আগের মতো আবার জোড়া লেগে যাবে। ফেরেশতা পুনরায় তার মাথার উপরে পাথর নিক্ষেপ করবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে।
৩. জেনাকারী, নারী-পুরুষের অবৈধ যৌন সম্পর্কের শাস্তি: চুলার ন্যায় বড় একটা গর্ত থাকবে যেন সেটা বিশাল একটা কড়াই। গর্তের উপরিভাগ হচ্ছে সরু ও নীচের অংশ চওড়া এবং এর নিচ থেকে আগুন জ্বলতে থাকবে। এর ভেতরে জেনাকারী নারী ও পুরুষদেরকে উলংগ করে আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হবে। আগুন গর্তের একেবারে মুখের কাছে চলে আসলে জেনাকারীরা আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে উপরে চলে আসবে যেন তারা গর্ত থেকে পালিয়ে যেতে পারে। ফেরেশতারা তাদেরকে আবার আগুনের গর্তে ফেরত পাঠাবেন। আগুনের তাপ একটু কমে আসলে তারা আবার গর্তে নিচে ফিরে যাবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে। ঘরে স্বামী/স্ত্রী রেখে অন্য কারো সাথে জেনা করার শাস্তি: নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মি’রাজের রাত্রিতে একদল লোকের কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন তাদের সামনে একটি পাত্রে গোশত রান্না করে রাখা হয়েছে। অদূরেই অন্য একটি পাত্রে রয়েছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত কাঁচা গোশত। লোকদেরকে রান্না করে রাখা গোশত থেকে বিরত রেখে পঁচা এবং দুর্গন্ধযুক্ত, কাঁচা গোশত খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা চিৎকার করছে এবং একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও তা থেকে ভক্ষণ করছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিবরীল ফেরেশতাক জিজ্ঞেস করলেনঃ এরা কোন শ্রেণীর লোক? জিবরীল বললেনঃ এরা আপনার উম্মতের ঐ সমস্ত পুরুষ লোক যারা নিজেদের ঘরে পবিত্র এবং হালাল স্ত্রী থাকা সত্বেও অপবিত্র এবং খারাপ মহিলাদের সাথে রাত কাটাতো। উৎসঃ আল-খুতাবুল মিম্বারিয়াঃ ডা সালেহ আল-ফাওজান।
৪. সুদখোরের শাস্তি: জাহান্নামে একটি রক্ত প্রবাহিত নদী আছে যার মাঝখানে সুদখোর দাঁড়ানো থাকবে। নদীর তীরে একজন ফেরেশতা থাকবে যার সামনে অনেক পাথর থাকবে। সুদখোর রক্তের নদী থেকে বের হয়ে আসার জন্য তীরে আসার চেষ্টা করলে তীরে দাঁড়ানো আজাবের ফেরেশতা সে ব্যক্তির মুখ বরাবর পাথর নিক্ষেপ করবে, এতে সুদখোর আবার নদীর মাঝখানে চলে যাবে। এমনভাবে যতবার সুদখোর তীরে উঠে আসতে চেষ্টা করবে, ততবার ঐ ফেরেশতা তার মুখ বরাবর পাথর নিক্ষেপ করে পূর্বস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করবে। এইভাবে তাদেরকে কেয়ামত পর্যন্ত শাস্তি দেওয়া হবে। উপরের দীর্ঘ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সহীহ বুখারীঃ জানাজা অধ্যায়ে।
৫. এছাড়া উহুদ পাহাড়ের সমান ওজনের হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করা, বিষাক্ত সাপের দংশন, বিচ্ছুর কামড় ইত্যাদি শাস্তি থাকবে কবরে। কবরে আযাব হওয়ার কারণঃ কবরের আযাব হওয়ার কারণ হচ্ছে দুনিয়ার জীবনে #কবীরাহ গুনাহ বা বড় বড় পাপ কাজে লিপ্ত থাকা। কবীরাহ গুনাহতে লিপ্ত থাকা এবং তওবা না করে, সংশোধন না করেই মৃত্যুবরণ করা।
হাদীসে বিশেষ ২টি কারণ উল্লেখ করা আছে, যেই দুইটি পাপকে মানুষ ছোট মনে করে কিন্তু অনেকেই এই ২টি পাপ কাজের কারণে আযাব দেওয়া হবে। ১. চোগলখুরী করা (এক জনের গীবত আরেকজনের কাছে বলে মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করা)। ২. পেশাবের অপবিত্রতা থেকে সাবধান না থাকা।
একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনা বা মক্কার কোন একটি বাগানের পাশদিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তথায় তিনি দু’জন এমন মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলেন যাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তাদেরকে আযাব দেয়া হচ্ছে অথচ বড় কোন অপরাধের কারণে আযাব দেয়া হচ্ছে না।
অতঃপর তিনি বললেনঃ তাদের একজন পেশাব করার সময় আড়াল করতোনা। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগাত। বুখারীঃ কিতাবুল ওযু অধ্যায়। কাতাদা (রঃ) বলেনঃ আমাদেরকে বলা হয়েছে কবরের আযাবের এক তৃতীয়াংশ হবে #গীবতের কারণে, এক তৃতীয়াংশ # পেশাব থেকে সাবধান না থাকার কারণে এবং এক তৃতীয়াংশ #চুগলখোরীর কারণে। যেহেতু গীবতকারী এবং চুগলখোর মিথ্যা কথাও বলে থাকে তাই সে #মিথ্যাবাদীর শাস্তিও ভোগ করবে।
কবরের আযাব থেকে বাঁচার উপায়ঃ
১. কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া ও দুয়া করাঃ কবররে আযাব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে নিয়মিত দুয়া করতে হবে, বিশেষ করা দুয়া মাসুরাতে বেশি বেশি দুয়া করতে হব। যেই দুয়া মাসুরা পড়তে হবেঃ দুয়া মাসুরা অর্থ হচ্ছে হাদীসে বর্ণিত দুয়া যেইগুলো রাসুল সাঃ করতেন। আমাদের দেশের মানুষ মনে করে, দুয়া মাসুরা শুধু একটাই (আল্লাহুম্মা ইন্নি জালামতু নাফসান যুলমান কাসিরাও...), এটা ভুল। নামাযে সালাম ফিরানোর আগে পড়তে হয় এমন অনেক সুন্দর সুন্দর দুয়া আছে সহীহ হাদীসে। কারণ, ফরয নামাযে আত্তাহিয়্যাতু ও দুরুদ পড়ার পরে, সালাম ফেরানোর আগে দুয়া বেশি কবুল করা হয়। দুয়া মাসুরা এক বা একের অধিক, যত ইচ্ছা পড়া যায়। এইগুলো মুখস্থ করে আমল করা উচিত।
৪টি জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুয়া মাসুরা আছে। কবরের আজাব, জাহান্নামের আজাব, দুনিয়ার ফেতনা ও মৃত্যুর সময়ের ফেতনা ও দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য দুয়া মাসুরাঃ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এইগুলো থেকে বাঁচার জন্য ফরয, নফল বা সুন্নত, যেকোনো সালাতে তাশাহুদ ও দুরুদের পরে সালাম ফিরানোর আগে এই দুয়া পড়তে বলেছেন। اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَمِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ، وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ، وَمِنْ شَرِّ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ. উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা ইন্নী আ’উযুবিকা মিন আ’যাবিল ক্বাবরি ওয়া মিন আ’যাবি জাহান্নাম, ওয়ামিন ফিতনাতিল মাহ’ইয়া, ওয়াল্ মামাতি, ওয়ামিং সাররি ফিতনাতিল্ মাসীহি’দ্-দাজ্জাল। অর্থঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাকে কাবরের আযাব থেকে রক্ষা করো,আমাকে জাহান্নামের আযাব, এবং দুনিয়ার ফিৎনা ও মৃত্যুর ফেতনা এবং দাজ্জালের ফিৎনা থেকে রক্ষা করো। বুখারী ২১০২, মুসলিম ১/৪১২, হিসনুল মুসলিম, পৃষ্ঠা – ৯০। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দুয়া মাসুরা হিসেবে এই দুয়া পড়তে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন।
২. কবীরা গুনাহ, যেইগুলো বড় বড় পাপকাজ, সেইগুলো যে কারনে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে, সেইগুলো বর্জন করা ও আল্লাহর বেঁধে দেওয়া ফরয ও ওয়াজিব হুকুম পালনে যত্নবান হওয়া।
৩. সুরা মুলক প্রতিদিন সুরা মুলক তেলাওয়াত করলে আশা করা যায় আল্লাহর রহমতে কবরের আজাব ও কেয়ামতের দিন শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকা যাবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রতিদিন রাতের বেলা তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক) তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন। রাসুলুল্লাহ সাঃ এর যামানায় এই সুরাটিকে আমরা “আল-মা’আনিয়াহ” বা সুরক্ষাকারী বলতাম। যে রাতের বেলা এই সুরাটি পড়বে সে খুব ভালো একটা কাজ করলো”। সুনানে আন-নাসায়ী ৬/১৭৯, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান সহীহ, সহীহ আত-তারগীব ওয়াল তারহীব ১৪৭৫। এই সুরা প্রত্যেকদিন রাতের বেলা তেলাওয়াত করলে কিয়ামতের দিন শাফায়াত করে জান্নাতে নিয়ে যাবে ইন শা’ আল্লাহ।
রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেনঃ “কুরআনে এমন একটা সুরা আছে যার মধ্যে ৩০টা আয়াত রয়েছে যেটা একজন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর সেটা হলো তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা মুলক)”। সুনানে আত-তিরমিযী ২৮৯১, সুনানে আবু দাউদ ১৪০০, মুসনাদের আহমাদ, ইবনে মাজাহ ৩৭৮৬। ইমাম তিরমিযী বলেছেন হাদীসটি হাসান, ইবনে তাইমিয়্যা বলেছেন সহীহ মাজমু ২২/২২৭, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ, সহীহ তিরমিযী ৩/৬, সহীহ ইবনে মাজাহ ৩০৫৩।
বিঃদ্রঃ এইখানে তেলাওয়াত মানে শুধু তোতা পাখির মতো রিডিং পড়ে যাওয়া না। এই প্রসংগে সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের আলেমদের ফতোয়া হচ্ছেঃ “এই হাদীসগুলোর আলোকে বলা যায়ঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুরা মুলক বিশ্বাস করবে ও তেলাওয়াত করবে, এই সুরাতে যে শিক্ষা দেওয়া আছে তা গ্রহণ করবে এবং যে হুকুম আহকাম দেওয়া আছে সেইগুলো মেনে চলবে কেয়ামতের দিন তার জন্য এই সুরাটি শাফায়াত করবে”। ফতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ ৪/৩৩৩-৩৩৫।
এমটিনিউজ/ রাসেল/মাহমুদ