সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : ইসলামী ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, হজরত ইবরাহিম (আ.) তার দ্বিতীয় স্ত্রী হজরত হাজেরা (রা.) কে দুগ্ধপোষ্য শিশু হজরত ইসমাঈল (আ.) সহ আরবের জনশূন্য মরু অঞ্চলে নির্বাসিত করেছিলেন। সেখানে থাকাকালে শিশু ইসমাঈল (আ.) পানির তৃষ্ণায় পিপাসিত হলে হজরত হাজেরা পানির সন্ধানে উত্তপ্ত বালুকাময় মরুভূমিতে সাফা-মারওয়া নামক স্থানে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। অন্যদিকে আল্লাহর নবী শিশু ইসমাঈল (আ.) পানির তৃষ্ণায় তার পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করছিলেন। আর এ আঘাতেই মহান আল্লাহর কুদরতে সেখানে হঠাৎ মাটির ভেতর থেকে পানি উঠতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে একটি সুপেয় পানির কূপে পরিণত হয়। আর সেটিই আজকের জমজম কূপ।
অন্য বর্ণনা মতে, শিশু ইসমাঈল (আ.) এর কান্না দেখে মহান আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা হজরত জিবরাঈল (আ.) কে সেখানে প্রেরণ করেন। জিবরাঈল (আ.) সেখানে এসে তার পায়ের আঘাতে একটি পানির ঝরনার সৃষ্টি করেন।
নামকরণের কারণ : আরবি ভাষায় 'জমজম' অর্থ অঢেল পানি আর তিবরানি ভাষায় জমজম অর্থ 'থাম থাম'। শিশু ইসমাঈলের পায়ের নিচে পানির ফোয়ারা দেখে হাজীরা বলেছিলেন, জমজম (থাম থাম)। অনেকের ধারণা, এ থেকেই এর নাম জমজম হয়েছে। জমজমকে রাকদাতু জিবরিল ও বির-ই-ইসমাঈলসহ ১২টি নামে অভিহিত করা হয়।
পুনঃসংস্কারের ইতিহাস : আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগে জমজম কূপ খনন করা হয়। কিন্তু এর কয়েক শতাব্দী পরে হঠাৎ করে কূপের পানি বন্ধ হয়ে যায়। তখন কাবার তত্ত্বাবধানে ছিল জারহাম গোত্র। তারা কাবায় নানা অন্যায় গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। তাদের এহেন গর্হিত কাজ সহ্য করতে না পেরে 'খোজায়া' গোত্রের লোকরা জারহামের ওপর আক্রমণ চালায় এবং হেরেম থেকে তাদের বের করে দেয়। যাওয়ার সময় তারা কূপটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে যায়। সে থেকে ৫০০ বছর পর্যন্ত জমজম কূপটি অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে থাকে। কেউ তার সন্ধান দিতে পারেনি। অতঃপর খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রাসুল (সা.) এর পিতামহ হজরত আবদুল মুত্তালিব কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সেই কূপটি পুনরুদ্ধার করেন। এটি তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে তিনি এটির পুনর্খনন করেন।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এই কূপকে কেন্দ্র করে মার্বেল পাথরের একটি গম্বুজ নির্মাণ করেন। ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল মাহদি জমজম কূপের পুনরায় সংস্কার করেন। তিনি সেগুন কাঠ দিয়ে একটি গম্বুজ নির্মাণ করেন, যেটি মোজাইক করা অংশ আবৃত করেছিল। তখন গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দুইটি। ছোটটি কূপের জন্য এবং বড়টি ছিল দর্শনার্থীদের জন্য। ৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল মুতাসিমের সময় গম্বুজ মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয়। জমজম কূপকে আধুনিকায়ন করা হয় ১৯১৫ সালে অটোমান সুলতান আবদুল হামিদের সময়।
ইবনে বাদি (রহ.) বলেন, হারাম শরিফে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে হাজরে আসওয়াদ, হাতিম, জমজমের পানি। এ পানি রোগের জন্য সুস্থতা এবং শরীরের জন্য খাদ্যস্বরূপ।
কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন জমজম : বিগত ৬০'র দশকে বাদশাহ খালেদের শাসনামলে আধুনিক যন্ত্রপাতির দ্বারা জমজম কূপ পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখন এই কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলী ইয়াহইয়া কোশকের প্রদত্ত বিবরণ থেকে জানা যায়, এই পানি বড় ধরনের কয়েকটি পাথরের তলদেশ থেকে প্রবল বেগে উৎসারিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় পাথরের চাঙ্গটির ওপর স্পষ্ট আরবি হরফে বিসমিল্লাহ কথাটি লেখা আছে। আবদুল মুত্তালিবের সময় কূপের গভীরতা ছিল মাত্র ১৪ ফুট। খলিফা মামুনুর রশীদের আমলে পুনরায় তা খনন করা হয়। এ সময় পানির নিঃসরণ খুব বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি কূপের বাইরে উপচেপড়া শুরু করেছিল। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পর সৌদি সরকার আধুনিক মেশিনের সাহায্যে কূপকে পুনর্খনন করেন। বর্তমানে এর গভীরতা ৫১ ফুট। দুইজন ডুবুরি তলদেশে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, সেখানে রঙ-বেরঙের মাটির স্তর জমাট বেঁধে আছে, আর অবিরাম নির্গত পানিকে পরিশোধন করছে। তারা আল্লাহর এ কুদরত দেখে বিস্মিত হয়ে যান।
জমজম পানিতে বিদ্যমান স্বাস্থ্যকর উপাদান : জমজম কূপের পানির কোনো রঙ বা গন্ধ নেই, তবে এর বিশেষ স্বাদ রয়েছে। কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় জমজম কূপের পানি পরীক্ষা করেছে এবং তারা এর পুষ্টিগুণ ও উপাদানগুলো নির্ণয় করেছে। জমজম পানির উপাদানগুলো হলো- প্রতি লিটারে আছে সোডিয়াম ১৩৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৯৬ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ৩৮.৮৮ মিলিগ্রাম, ফ্লোরাইড ০.৭২ মিলিগ্রাম, নাইট্রেট ১২৪.৮ মিলিগ্রাম, সালফেট ১২৪ মিলিগ্রাম।
আরও কিছু তথ্য
* আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতে ৪ হাজার বছর আগে সৃষ্টি হয়েছিল।
* ভারি মোটরের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে ৮ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করার পরও পানি ঠিক সৃষ্টির সূচনাকালের মতো।
* পানির স্বাদ পরিবর্তন হয়নি, জন্মায়নি কোনো ছত্রাক বা শৈবাল।
* সারা দিন পানি উত্তোলন শেষে মাত্র ১১ মিনিটেই আবার পূর্ণ হয়ে যায় কূপটি।
৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/এমআর