সোমবার, ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১১:০৯:১৯

পবিত্র হজের ১৪০০ বছরের জানা-অজানা ইতিহাস

পবিত্র হজের ১৪০০ বছরের জানা-অজানা ইতিহাস

পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতায় সারাবিশ্বের ২০ লাখ মুসলিম সোমবার সমবেত হন পবিত্র আরাফাত ময়দানে। ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনির মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ রব্বুল আল আমিনের দরবারে নিজের উপস্থিতি জানান দেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা লাখ লাখ মুসল্লি।

এই ২০ লাখ হাজি ফজর নামাজ আদায় করে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ট্রেন, বাস এমনকি ভিড় এড়াতে অনেক হাজি মধ্যরাত থেকে পায়ে হেঁটে মিনা ত্যাগ করেন।

মুসলমানদের জন্য একটি আবশ্যকীয় ইবাদত হজ, যা ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ। ১ হাজার ৪০০ বছরেরও আগে থেকে হজ পালন হয়ে আসছে। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান প্রতিনি মুসলিমের জন্যই জীবনে অন্তত একবার হজ পালন করা আবশ্যক।

হজ পালনের জন্য পাঁচদিনব্যাপী ভ্রমণের শুরুটা হয় মক্কা থেকে। এজন্য প্রত্যেককেই ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি পায়ে হাঁটতে হয়।

অতীতের চেয়ে বর্তমানে হজ পালন এখন অনেকটাই সহজ। অতীতে যেসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হত তা বহুলাংশে কমে গেছে। সৌদি সরকার প্রযুক্তি, সেবা, আতিথেয়তা এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বহুদূর অগ্রসর হওয়ায় হজ যাত্রী ও তাদের পরিবারের কষ্ট-দুর্ভোগ অনেকটাই কমেছে।

সৌদি রাষ্ট্র ও বর্তমান রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে আরব উপদ্বীপ অনেক ছোট ছোট গোত্র এবং শেখশাসিত অঞ্চল দ্বারা গঠিত ছিলো। ফলে অঞ্চলটিতে বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা লেগেই ছিলো। যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হতো হজ যাত্রীরা। অপরিচিত অঞ্চল দিয়ে অরক্ষিত অবস্থায় এই যাত্রায় ভোগান্তিতে পড়তে হতো তাদের।

১৯ শতকের শুরুতে মক্কা যাত্রার পথটিতে নিরাপত্তা ছিলো না বললেই চলে। হজ যাত্রা শুরুর আগে থেকেই অনেকে জানতো- তারা তাদের জীবনটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

যাযাবর জাতি বেদুইন অনেক সময়ই হজ যাত্রীদের বহর আক্রমণ করতো, প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী লুট করে নিতো। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে প্রাণটাই দিতে হতো। বেঁচে থাকলেও প্রয়োজনীয় জিনিস হারিয়ে কঠিন বিপদের সম্মুখিন হতো। পানির কষ্টই ছিলো প্রধান। প্রতিকূল আবহাওয়াও অনেকের প্রাণ কেড়ে নিতো।

২০ শতকের শুরুতে পরিবহনের ক্ষেত্রে আধুনিক পদ্ধতির সূচনা হয়। ১৯০৮ সালে হেজাজ রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সুবিধার প্রচলন, যা দামেস্ক থেকে মদিনা যেতো। অটোমান সাম্রাজ্যের নির্দেশেই এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়, যার অর্থায়ন করে ডয়েচে ব্যাংক এবং যাতে জোড়ালো সমর্থন দেয় তৎকালীন জার্মান সাম্রাজ্য। এর ফলে একজন হজ যাত্রীর মক্কা যাত্রার সময় অনেকটাই কমে যায়, যেখানে বাষ্পচালিত নৌযানে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতো সেখানে ট্রেনে লাগতো মাত্র চারদিন।

১৯২০ এর দশকের শেষ দিকে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা কিং আব্দুল আজিজ কেন্দ্রীয় আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ এলাকা দখলের মাধ্যমে তার ক্ষমতা সংহত করতে থাকেন। ১৯২৫ সালে শরীফ হোসেনের কাছ থেকে পবিত্র শহর মক্কা দখল করার মাধ্যমে ৭০০ বছরেরও বেশি সময়ের হাশেমি শাসনের ইতি টানেন তিনি। মক্কা, মদিনা এবং জেদ্দার প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা এখন কিং আব্দুল আজিজকে হেজাজের রাজা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ১৯২৭ সালে নাজদও রাজতন্ত্রের অধীনে আসে। পরের পাঁচ বছর কিং আব্দুল আজিজ কিংডম অফ হেজাজ এবং কিংডম অফ নাজদ এই দুই রাজ্য পরিচালনা করেন। ভিন্ন রাজ্য হিসেবে এদের শাসন করলেও সেগুলো থাকে সম্পূর্ণ তার নিয়ন্ত্রণে। ১৯২৯ সালে কিং আব্দুল আজিজ আনুষ্ঠানিকভাবে হেজাজ ও নাজদকে  একত্রিত করেন, যা ১৯৩২ সাল থেকে কিংডম অব সৌদি আরব নামে পরিচিত পায়।

এর কয়েক বছর পরেই ১৯৩৮ সালে সৌদি আরবে তেল আবিষ্কৃত হয়। সৌদি কর্মকর্তাদের অংশীদার স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানিতে কাজ করা মার্কিন ভূতাত্ত্বিকরা এই আবিষ্কার করেন। তখন এই অঞ্চলজুড়ে কিং আব্দুল আজিজের অসামান্য প্রভাব আরও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য অঞ্চল জয় করতে ক্ষমতা ব্যবহারের বদলে কিং আব্দুল আজিজ তার ব্যাপক প্রভাব কাজে লাগান নব্য রাষ্ট্রে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায়। তিনি অভ্যন্তরীণ বিবাদ সংঘাত ত্যাগ করতে বেদুইনদের বাধ্য করেন, যেগুলোতে প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্থ হতো হজ যাত্রীরা। কিং আব্দুল আজিজের জন্য হজ যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিমানের মাধ্যমে আধুনিক পরিবহনের সূচনা হয়, যেখানে কিংডম অ্যারাবিয়ান ট্রান্সপোর্ট  অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে এবং বাখাশাব ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি ১৯৪৮ সালে। তবে হজ যাত্রীদের জন্য প্রথম আনুষ্ঠানিক বিমান পরিবহন চুক্তিটি হয় ১৯৩৭ সালে সৌদি সরকার ও মিশরের মিসর এ্যায়ারলাইন্সের মধ্যে। তবে এই বিমান পরিবহন জুড়েই ছিলো ইঞ্জিন ত্রুটির মতো সমস্যা, যা পরিবহনকে বিঘ্নিত করে। এছাড়াও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল ব্যাপি সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে হজ যাত্রীর সংখ্যাও অনেক কমে যায়। যুদ্ধ শেষ হলে বিমান পরিবহন অনেক কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৫০ সালের মধ্যে হজ যাত্রার জন্য উটের ব্যবহারও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

অনেক দিক থেকেই আজকের হজ যাত্রার সাথে ২০ শতকের গোড়ার দিকের সময়কার মিল নেই। বিমান পরিবহন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমুদ্র ও ট্রেনে যাত্রার বিকল্প হয়ে গেছে। ফলে হজের জন্য মাসব্যাপি বহু স্থানের মাধ্যমে ভ্রমণের বিষয়টি এখন আরও অনেক দ্রুত ও নিরাপদ হয়েছে। সরাসরি মক্কা যাত্রাও নিশ্চিত হয়েছে।

আজকের দিনে মক্কা মেট্রো ৩ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি হজ যাত্রীকে মিনা থেকে আরাফাত এবং আবারও মিনাতে নিয়ে আসছে। এটা প্রতিদিন ২০ লাখ হজ যাত্রীর চেয়েও বেশি। এখানে ইলেকট্রনিক ম্যাপ রয়েছে যাতে বহু ভাষার ব্যবস্থা রয়েছে হজ যাত্রীদের বৈচিত্র বিবেচনায়। পানির সরবরাহও অনেক উন্নত হয়েছে, একই সাথে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ৩৬ হাজারেরও বেশি বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা রয়েছে। হাজারও সরকারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা, জরুরি সেবা এবং স্বেচ্ছাসেবক হজ যাত্রীদের গাইড করছে তাদের যাত্রার প্রতিটি স্তরে।

নতুন চিকিৎসা সামগ্রী নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে অসুখ এবং পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে। বিনামূল্যের চিকিৎসা সেবাও দেয়া হচ্ছে শতাধিক আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে, যার প্রতিটিতেই রয়েছে একজন চিকিৎসক, একজন নার্স এবং সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এছাড়াও এখন অনেক তাবুতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও রয়েছে।
সূত্র: চ্যানেল আই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে