ইসলাম ডেস্ক : পবিত্র কাবা শরিফ থেকে ২০ মিটার বা ৬৬ ফুট (মতান্তরে ২১ মিটার) পশ্চিমে মসজিদে হারামের ভেতরেই এ কূপের অবস্থান। শরীফ ওসমানী নিরাকার প্রভু স্বীয় অস্তিত্বের জানান দিতে পৃথিবীতে অসংখ্য আকরিক ও অলৌকিক নিদর্শন স্থাপন করেছেন। স্বীয় নির্বাচিত প্রেরিত পুরুষ কর্তৃক এসব অলৌকিক বস্তু ও নিদর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সত্যসন্ধানী যে কেউ যাতে করে খুঁজে নিতে পারে মুক্তির পথ, হেদায়েতের আলোকবর্তিকা।
জমজম কূপ সেসব অলৌকিক নিদর্শনের অন্যতম। এর অবস্থান ও অবকাঠামো- প্রায় ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট চওড়া একটি আয়তক্ষেত্রের মতো কূপটি। যার গভীরতা ৩০ মিটার বা ৯৮ ফুট। (মতান্তরে ১২০ বা ১৪০ ফুট গভীর)। ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে এই কূপের ছিল দুটি জলাধার। একটি হচ্ছে খাওয়ার জন্য। অন্যটি অজু করার জন্য। বর্তমানে বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে পানি উত্তোলন করা হয়।
'জমজম' নাম কীভাবে এলো? : আরব্য ঐতিহাসিকদের মতে, 'জমজম' অর্থ অধিক হওয়া। এখানে পানির আধিক্যের কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে 'জমজম'।
* গবেষকরা মনে করেন, 'জমজম' অর্থ সমবেত হওয়া। মা হাজেরা (প্রকৃতপক্ষে হাজের) (আ.) ডানে-বাঁয়ে পানির প্রবাহ রোধ করে মাটির বাঁধ দিয়ে পানি সঞ্চিত করে রেখেছেন বলে একে 'জমজম' বলা হয়।
* হিব্রু ভাষায় 'জমজম' অর্থ থাম-থাম। মা হাজেরা (আ.) পানির প্রবাহ রোধ করার জন্য বাঁধ নির্মাণের সময় বলেছিলেন, 'জমজম'- থাম-থাম। আল্লাহর ইচ্ছায় তা নির্দিষ্ট স্থানে থেমে গেল।
* আল্লামা মাসউদি (রহ.) বলেন, প্রাচীনকালে ঘোড়া এ কূপ থেকে পানি পান করেছিল। পানি পানের সময় ঘোড়ার আওয়াজকে 'জমজম' বলা হয়। সে হিসেবে এ কূপকে 'জমজম' নামে নামকরণ করা হয়েছে।
একাল-সেকালা : রাসুল (সা.)-এর জন্মের প্রায় দুই হাজার ৫৭২ বছর আগে, আমাদের যুগ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে জমজমের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছিল। আল্লাহর আদেশে জিবরাইল (আ.)-এর হাতে, ইসমাঈল (আ.)-এর পায়ের আঘাতে এর উৎপত্তি হয়েছিল। আল্লাহর আদেশে সুদূর ফিলিস্তিন থেকে মা হাজেরা (আ.) জনমানবহীন মরুময় মক্কায় নির্বাসিত হয়েছিলেন।
সঙ্গে আনা সামান্য খেজুর ও পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর একটু পানির খোঁজে অস্থির হয়ে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার 'সায়ি' (চক্কর) করেন। সপ্তমবারে 'মারওয়া' পাহাড়ের ওপর থেকে একটি শব্দ শুনে তিনি নিচে নেমে আসেন। আর তখনই তিনি দেখতে পান, আল্লাহর এই অবারিত ঝরনাধারা থেকে রহমতের বারিধারা বর্ষিত হচ্ছে। পৌত্তলিক যুগে জুরহাম গোত্র খোজায়া গোত্র কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত ও বিতাড়িত হয়ে মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় এ কুয়া তারা মাটি দিয়ে ভরে দেয়।
প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর পর স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মুত্তালিব স্বীয় পুত্র হারেসকে সঙ্গে নিয়ে তা পুনরায় খনন করেন। ৭৭১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মনসুর এই কূপকে উপলক্ষ করে একটি মার্বেল পাথরের গম্বুজ নির্মাণ করেন। ৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মাহদি সেগুন কাঠের আরেকটি গম্বুজ নির্মাণ করেন।
৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে খলিফা মুতাসিম গম্বুজটি মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মাণ করেন। ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে মামলুকদের আমলে গম্বুজটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সুলতান আবদুল হামিদ কূপটি আধুনিকায়ন করেন।
জমজমের পানির ফজিলত : রাসুল (সা.)-এর 'সাক্কে ছাদার' বা বক্ষ বিদীর্ণ করে হজরত জিবরাইল (আ.) জমজমের পানি দিয়ে তা ধৌত করেন। (বুখারি-৩৩৪২)
* রাসুল (সা.) বলেন, 'ভূপৃষ্ঠের মধ্যে সর্বোত্তম পানি জমজমের পানি। তাতে ক্ষুধার্ত ব্যক্তির খাদ্য ও অসুস্থ ব্যক্তির আরোগ্য রয়েছে।' (তাবরানি-১১১৬৭)
* সাহাবাগণ ও পূর্বের মনীষীগণ মেহমানদের জমজমের পানি উপহার দিতেন। (আখবারে মক্কা)
* রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যে উদ্দেশ্যে জমজমের পানি পান করা হয়, আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করেন।' (আহমদ, ইবনে মাজাহ)
কুদরতের অপূর্ব কারিশমা : সৌদি আরবের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বোর্ডের জমজম কূপের ওপর একটি গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। তারা বলছে, জমজম কূপের তলদেশে পানির স্তর ১০.৬ ফুট। ভারী মোটরের সাহায্যে প্রতি সেকেন্ডে আট হাজার লিটার পানি পাম্প করে উঠিয়ে নিয়ে পানির স্তর ৪৩.৯ ফুট পূর্ণ করলেও পাম্প থামানোর ১১ মিনিটের মধ্যে তা আবার যথারীতি আগের মতো পূর্ণ হয়ে যায়।
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/কেএম/মোস্তাক/