মাহবুবুর রহমান নোমানি: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অতি আদরের নাতি হুসাইন (রা.) খাতুনে জান্নাত ফাতেমা (রা.)-এর দ্বিতীয় সন্তান। তিনি চতুর্থ হিজরির ৩রা শাবান মোতাবেক ৮ জানুয়ারি ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্মের পর নবীজি (সা.) তাঁর কানে আজান দেন, সপ্তম দিনে আকিকা করেন এবং মাথার চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকা করেন। পিতা আলী (রা.) নাম রাখেন ‘হারব’। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) তা পরিবর্তন করে নাম রাখেন ‘হুসাইন’। শারীরিক গঠন, আকৃতি ও চারিত্রিক গুণাবলির দিক থেকে তিনি ছিলেন প্রিয়তম নানা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রতিচ্ছবি। অধিক পরিমাণে রোজা রাখতেন এবং নামাজ আদায় করতেন। তাঁর দান-দক্ষিণার হাত ছিল সদা প্রসারিত। অসহায় ও মিসকিনদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাঁর পছন্দনীয়। ২৫ বার হেঁটে বায়তুল্লাহ শরিফের হজ সম্পাদন করেছেন।
অনন্য মর্যাদা
হুসাইন (রা.) নবী পরিবারে প্রতিপালিত হয়েছেন। নবীজি (সা.) তাঁকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। আনন্দ দানের উদ্দেশে তাঁর সঙ্গে খেলায় মেতে উঠতেন। বুকে জড়িয়ে চুমু খেতেন আর বলতেন, ‘হুসাইন আমার; আমি হুসাইনের।’ ইয়ালা ইবনে মুররা (রা.) বলেন, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে খাবার খেতে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে শিশু হুসাইনকে খেলায় মত্ত দেখে রাসুল (সা.) দ্রুত অগ্রসর হয়ে তাঁকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করেন; কিন্তু হুসাইন ধরা না দিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। নবীজিও তাঁর পিছু পিছু ছুটতে থাকেন। অবশেষে তাঁকে ধরে কোলে তুলে নেন এবং গণ্ডদ্বয়ে স্নেহের চুমু এঁকে দেন। অতঃপর বলেন, ‘হুসাইন আমার, আমি হুসাইনের। যে ব্যক্তি হাসান-হুসাইনকে ভালোবাসবে, আলাহও তাকে ভালোবাসবেন।’ (তারিখে কাবির)
ইয়াজিদের বায়েত গ্রহণে অস্বীকৃতি
মুয়াবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী খেলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত হয় তদীয় পুত্র ইয়াজিদ। নবীদৌহিত্র হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের হাতে বায়েত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তিনি ভেবেছিলেন, খেলাফতের জন্য তিনিই বেশি যোগ্য। আর এতে সন্দেহ নেই যে হুসাইন (রা.) জ্ঞান, গরিমা, আলম, আখলাক সর্বদিক থেকে ইয়াজিদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন।
কুফার পথে হুসাইন (রা.)
কুফাবাসী হুসাইন (রা.)-এর বায়েত গ্রহণ না করার বিষয়টি জানতে পেরে তাঁর কাছে চিঠি প্রেরণ করতে থাকে যে ‘আপনি এখানে চলে আসুন। আমরা আপনার হাতে বায়েত গ্রহণ করব।’ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য হুসাইন (রা.) চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে পৌঁছে হুসাইন (রা.)-এর পক্ষ থেকে বায়েত গ্রহণ শুরু করেন। এবং পত্র মারফত তাঁকে কুফায় আগমনের আমন্ত্রণ জানান। সে অনুযায়ী হুসাইন (রা.) ৬০ হিজরির ৯ জিলহজ মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা করেন। ততক্ষণে কুফার পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কুফার নতুন গভর্নর উবায়দুলাহ বিন জিয়াদ হজরত হুসাইন (রা.)-এর যাত্রা প্রতিহত করার জন্য হুর বিন ইয়াজিদের নেতৃত্বে এক দল সৈন্য প্রেরণ করে।
কারবালার প্রান্তরে হুসাইন (রা.)
হুসাইন (রা.) চলতে চলতে কারবালা নামক স্থানে পৌঁছে বাধাপ্রাপ্ত হন। তিনি অস্ফুটচিত্তে বললেন, ‘হাজা কারবুন ওয়া বালাউন’ এটা সংকটময়, বিপদসঙ্কুল স্থান। তিনি সঙ্গীদের এখানেই তাঁবু গাড়তে নির্দেশ দেন। হুর বিন জিয়াদ হুসাইন (রা.)কে বললেন, ‘আপনি কুফা ছাড়া যেদিকে ইচ্ছা যেতে পারেন। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনাকে যেন কিছুতেই কুফা প্রবেশ করতে না দিই।’ কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদ সীমারকে নতুন সেনাপতি নিয়োগ করে নির্দেশ দিল, হুসাইনকে ইয়াজিদের হাতে বায়েত গ্রহণে বাধ্য করবে নতুবা তাঁর শির আমার সামনে উপস্থিত করবে। সীমার কারবালায় পৌঁছে গনর্ভরের নির্দেশ শুনালে হুসাইন (রা.) তাকে তিনটি প্রস্তাব দেন। ‘১. আমাকে মদিনায় যেতে দাও। ২. সরাসরি ইয়াজিদের কাছে পাঠিয়ে দাও। ৩. কোনো ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দাও।’ কিন্তু ইয়াজিদের সৈন্যরা কোনো প্রস্তাবই মানতে রাজি হলো না। তারা ইবনে জিয়াদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেই দৃঢ়তা দেখাল। অবশেষে বেধে যায় যুদ্ধ। সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে হজরত হুসাইন (রা.)-এর সঙ্গী ছিলেন ইয়াজিদের বাহিনী থেকে নেহাত অপ্রতুল। হুসাইন (রা.)-এর সব সঙ্গী বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। সবার শেষে হুসাইন (রা.) বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে তিনিও শাহাদাতের সুধা পান করেন।
কারবালা ঘটনার মূল্যায়ন
কারবালা প্রান্তরে নবীদৌহিত্র হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্যই বেদনাদায়ক। তবে কারো মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করে বিলাপ করা, শরীর জখম করা, মাথা ও বুক চাপড়ানো ইসলামে জায়েজ নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ যে ব্যক্তি কারো মৃত্যুতে গালে চপেটাঘাত করল কিংবা শরীরের কাপড় ছিঁড়ে ফেলল, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (বোখারি) তিনি আরো বলেন, ‘মৃত ব্যক্তি জন্য বিলাপ করা জাহেলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত। বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আলাহ তায়ালা তাকে আলকাতরার প্রলেপ লাগানো জামা এবং অগ্নিশিখা দ্বারা তৈরি কোর্তা পরাবেন।’ (ইবনে মাজাহ)
মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা সর্বসম্মতিক্রমে নিষিদ্ধ। শিয়া আলেম ইবনে বাবুওয়াই আল কুম্মি বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির ওপর উচ্চৈঃস্বরে রোদন করা জাহেলিয়াতের কাজ।’ (বিহারুল আনওয়ার/১০৮২)
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, হাদিসে এত কঠোরবাণী উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও শিয়া সম্প্রদায় হুসাইন (রা.) মৃত্যুতে মাত্রারিক্তি বাড়াবাড়ি করে থাকে। তারা ১০ মহররমে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করে জাঁকজমকের সঙ্গে তাজিয়া মিছিল বের করে এবং নিজেদের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, যা সম্পূর্ণ শরিয়ত গর্হিত, নাজায়েজ ও জঘন্যতম বেদাত।
হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের পূর্বাভাস
এ সম্পর্কে হাদিসে বহু বর্ণনা এসেছে। রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময়ে সাহাবাদের হুসাইনের শাহাদাত সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এখানে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো— ১. উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা হোসাইন (রা.) নবীজি (সা.) এর ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) কী যেন হাতে নিয়ে নাড়াচড়া করছেন। আর তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘জিবরাঈল আমাকে জানিয়ে গেলেন, আমার উম্মত এ সন্তানকে হত্যা করবে এবং সেই জমিনের মাটিও আমাকে দেখালেন।’ (মুসনাদে ইসহাক)
২. আয়শা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ভূমিতে হুসাইনকে হত্যা করা হবে জিবরাঈল আমাকে সে স্থানের মাটি দেখিয়েছেন। যে ব্যক্তি হুসাইনের রক্ত ঝরাবে সে মহান আল্লাহর রোষানলে পতিত হবে। হে আয়শা, এ ঘটনা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। আমার উম্মতের মধ্যে কে সেই ব্যক্তি যে আমার হুসাইনকে হত্যা করবে?’ (কান্জুল উম্মাল)
৩. আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার এ দৌহিত্রকে ইরাকের এক এলাকায় হত্যা করা হবে। অতএব, তোমাদের মধ্যে থেকে যারা তাকে ওই অবস্থায় পাবে, তাকে যেন সাহায্য করে।’ (কালেরকন্ঠ)-লেখক : শিক্ষক, জামেয়া উসমানিয়া সাতাইশ, টঙ্গী, গাজীপুর
এমটিনিউজ২৪.কম/হাবিব/এইচআর