ইসলাম ডেস্ক: তওবা হলো অতীতের গোনাহের অনুশোচনা। ইবাদতসমূহের মধ্যে তওবা অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি সর্বাবস্থায় সর্বত্র সকলের জন্য প্রযোজ্য। তওবা মানুষের জীবনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় তওবা হলো- স্থায়ী অনুশোচনা ও অধিক ক্ষমা প্রার্থনার সঙ্গে আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা। তওবা প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমের সূরা আন নুরে ইরশাদ হয়েছে,
‘হে মুমিনরা! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারে।’ তওবাকারীকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন। এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘মহান আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ -সূরা আল বাকারা: ২২২
তওবা সম্পর্কে হাদিসেও প্রচুর বর্ণনা রয়েছে। এক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহর নিকট তওবা করো, আমি দৈনিক একশ’ বার তার নিকট তওবা করি।
’ অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পাপ থেকে তওবা করে সে এমন হয়ে যায়, যেন তার কোনো পাপই নেই।’
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য আরেক হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মানুষ মাত্রই পাপী, আর পাপীদের মধ্যে তওবাকারীরাই উত্তম। অন্তরের সব পঙ্কিলতা ঝেড়ে বিশুদ্ধ মনে তওবাকারীকে আল্লাহতায়ালা জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ!
তোমরা আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধচিত্তে তওবা করো, তাহলে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দকর্মসমূহ মিটিয়ে দেবেন এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত।’ -সূরা আত তাহরিম: ৮
আল্লাহতায়ালা তওবাকারীর তওবা কবুল করে তাকে শুধু পাপমুক্তই করেন না, বরং তার পাপকে পুণ্যে রূপান্তরিত করেন। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। আল্লাহতায়ালা তাদের পাপকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ -সূরা আল ফুরকান: ৭০
যাদের তওবা কবুল করা হয় : অজ্ঞতাবশত পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার পর যারা তওবা করে আল্লাহতায়ালা তাদের তওবা করে থাকেন। এ ছাড়া আরও যাদের তওবা কবুল করা হয় তারা হলো- যারা পাপকর্ম থেকে বিরত থেকে নিজেদের সংশোধন করে নেয়, ঈমান আনার পর সৎকর্ম সম্পাদন করে, না দেখেই আল্লাহতায়ালাকে ভয় করে, তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে স্বীয় জানমাল উৎসর্গ করে, আল্লাহর পথে দান-সদকা করে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যথাযথ অনুসরণ করে, মানুষের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেয়, সর্বদা সত্য ও সঠিক কথা বলে এবং যারা সব ধরনের কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে।
যাদের তওবা কবুলযোগ্য নয় : এক. যারা শিরকে লিপ্ত হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তার শরিক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যে কেউ আল্লাহর শরিক করে সে এক মহাপাপ করে।’ -সূরা আন নিসা: ৪৮
দুই. যাদের মধ্যে মুনাফিকের দোষ বিদ্যমান। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো অথবা না করো, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ -সূরা আল মুনাফিকুন: ৬
তিন. যারা সীমালঙ্ঘন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা কুফরি করেছে ও সীমালঙ্ঘন করেছে আল্লাহ তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোনো পথও দেখাবেন না।’ -সূরা আন নিসা: ১৬৮
চার. ঈমান আনার পরও যারা পুনঃ পুনঃ কুফরি করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরি করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরি করে।’ (অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের নাম ঈমান, মুনাফিকরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য ‘ঈমান এনেছে’ বলে মুখে প্রকাশ করত, আবার সুযোগ সুবিধা পেলে সেটা অস্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করত না, আলোচ্য আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে) অতঃপর তাদের কুফরি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোনো পথে পরিচালিত করবেন না।’ -সূরা আন নিসা: ১৩৭
পাঁচ. যারা কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা কুফরি করে ও আল্লাহর পথ হতে মানুষকে নিবৃত্ত করে, অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।’ -সূরা মুহাম্মদ: ৩৪
তওবার দরজা কখন বন্ধ হবে : সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা রাতে নিজহাত প্রসারিত করেন- যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবা করে; এবং দিনে তার হাত সম্প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবা করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে।’ –সহিহ মুসলিম: ৩১/২৭৫৯
জেনে নিন আল্লাহর প্রিয় যারা!
আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে জান্নাত আর্জনই মুমিন-মুসলিমের লক্ষ্য। তাই মুমিনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ খুঁজে ফিরতে হয় সারাটা জীবন ধরে। মুমিন বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে নিজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একাত্মতা ঘোষনা করে, তারা কোরআনের আলোকে নিজের জীবন গঠনে সচেষ্ট হয়। যখন কোন ভুল হয়ে যায় তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পথে ফিরে আসে।
আল্লাহ কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় তিনি যাদেরকে ভালোবাসেন বা তাঁর প্রিয় হওয়ার নিমিত্তে করণীয় কি তা বর্ননা করেছেন।
যারা আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করে, রাগকে নিয়ন্ত্রন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে ইহসান তথা আনুগ্রহের পথে চলে আল্লাহ তাদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ বলেন- “ আর ব্যয় করো আল্লাহর পথে তবে নিজের জীবনকে ধংসের সম্মুখীন কোরো না। আর মানুষের প্রতি আনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদেরকে ভালোবাসেন”। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৫)
সুরা আল মায়িদায় আল্লাহ বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন, যারা ইহসানের পথে চলে”। (মায়িদা,আয়াত-১৩)
যারা সৎকর্মশীল তারাই আল্লাহর পছন্দের তালিকায়। সুরা আল ইমরানের ১৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- “যারা স্বচ্ছলতায় ও অভাবের সময় আল্লাহর পথে ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরন করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালবাসেন”।
ন্যায় বিচারক শাসককে আল্লাহ প্রিয় বান্দা হিসেবে গ্রহণ করবেন। হাদিসে বর্নীত হয়েছে ন্যায় বিচারক শাসক হাশরের দিনে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবেন। রাসুল (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন-
“যদি বিচার ফয়সালা করেন তাহলে ইনসাফের সাথে করুন, আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন”। (সুরা আল মায়িদা, আয়াত-৪২)।
আল্লাহ মুত্তাকী তথা আল্লাহভীরু, প্রতিশ্রুতি পুর্ণকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীগণকে ভালোবাসেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা তারা প্রতিশ্রুতি ভংগকারী নন। এমনকি মুশরিকদের সাথেও যদি কোন ব্যপারে চুক্তি করে থাকেন তাহলে তাও অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালন করে থাকেন। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন-
“হে ঈমানদার গণ ঐ সব মুশরিক যাদের সাথে তোমরা চুক্তি করেছো, এরপর যারা চুক্তি পালনে ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্বে কাউকে সাহায্য করেনি, এমন লোকদের সাথে তোমরাও চুক্তি মেয়াদ পুরা করো। আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন”।
(সুরা তাওবা, আয়াত-৪)
বান্দার তাক্বওয়া ও পবিত্রতা অর্জন আল্লাহর প্রিয় কাজের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ। সুরা তাওবার ১০৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- “ যে মসজিদ প্রথম দিন থেকেই তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরই বেশী হক যে আপনি সেখানে দাঁড়াবেন। সেখানে এমন সব মানুষ রয়েছে, যারা পবিত্র থাকা পছন্দ করে। আর আল্লাহ পবিত্রতা ইখতিয়ারকারীকেই পছন্দ করেন”।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার অভিপ্রায় থাকলে বিপদে আপদে দুঃখ শোকে চিন্তা- চেতনায় পরিপূর্ণ ভাবে আল্লহর উপর ভরসা করতে হবে। আল্লাহ কোরআনে বলেনঃ
“যা কিছু তোমাদের দেওয়া হয়েছে তা দুনিয়ার কদিনের জীবনের সাজ সরঞ্জাম মাত্র। আর যাকিছু আল্লাহর কাছে আছে তা যেমন বেশী ভালো, তেমনি স্থায়ী ঐসব লোকের জন্য যারা ঈমান এনেছে ও তাদের রবের উপর ভরসা করেছে। আর যারা কবিরা গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রয়েছে এবং রাগান্বিত হয়ে গেলেও মাফ করে দেয়”। (সুরা আশ-শুরা, আয়াত-৩৬-৩৭)
তাই আল্লাহর প্রিয় হতে হলে চাই কোরআন নির্দেশিত পথে চলা। আল্লাহর ভালোবাসায় বিলিন হয়ে রাসুলের আনুগত্য করা। ক্রোধ, লোভ, অশ্লিলতা থেকে মুক্ত হয়ে তাওবার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া।