ইসলাম ডেস্ক: বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের বর্তমান প্রধান আহমেদ শফি কিংবা সে দেশের প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ, মরহুম মৌলানা ভাসানিও পড়াশুনো করেছিলেন এই দেওবন্দেই। ভারতেও বদরুদ্দিন আজমল বা মাহমুদ মাদানির মতো রাজনীতিবিদ, কিংবা মালয়েশিয়া-পাকিস্তানের মতো দেশেও অনেক ইসলামী নেতার শিক্ষাদীক্ষা এই প্রতিষ্ঠানেই। কাজেই দেওবন্দের আকর্ষণ যে আন্তর্জাতিক, তা বলার কোনও অপেক্ষা রাখে না।
বিশ্বের বহু দেশের মুসলিমরাই তাদের ধর্মীয় পথনির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের দিকে, সে দেশের উলেমারা যে মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন ১৮৬৬ সালে। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করে থাকে যে তাবলীগ জামাত, তারাও এই দেওবন্দের অনুসারী বলেই পরিচিত। সম্প্রতি বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতে তিক্ত বিভাজনের পর একটি গোষ্ঠী তাদের করণীয় জানতে এই দেওবন্দেরই শরণাপন্ন হয়েছেন। কিন্তু ঠিক কী বিশেষত্ব এই প্রতিষ্ঠানের, যার জন্য দেশভাগের এত বছর পরও বাংলাদেশ-পাকিস্তানেরও বহু মুসলিম ধর্মীয় বিষয়ে দেওবন্দের ব্যাখ্যার ওপরই ভরসা রাখেন?
এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস খুঁড়ে সেটাই জানতে চেষ্টা করেছিলাম, আর গিয়েছিলাম সরেজমিনে দেওবন্দের বিখ্যাত মাদ্রাসা ঘুরে দেখতে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটারের পথ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দ। ওই অঞ্চলের আখের খেতের বুক চিরে গেছে যে মহাসড়ক, সেটাই আপনাকে নিয়ে ফেলবে ধূলিধূসর এই জনপদে– যার এক প্রান্তে বিশাল ক্যাম্পাস জুড়ে দারুল উলুম মাদ্রাসা। এই মুহুর্তে বিশ্বের নানা দেশের প্রায় হাজার ছয়েক মুসলিম ছাত্র পড়াশুনো করছেন সেখানে।
ভারতের তো বটেই, বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-মালয়েশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ব্রিটেন-আমেরিকা-দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও ছাত্ররা শিক্ষা নিতে আসেন এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে।
দেওবন্দে ছাত্রাবাসের চাতালে ছাত্ররা পড়াশুনো করছেন ভারতের সুপরিচিত ইসলামী ইতিহাসবিদ আখতারুল ওয়াসি বিবিসিকে বলছিলেন, দেড়শো বছর আগে ভারতে মুসলিম শাসনের অবসানের পরই কিন্তু দেওবন্দ স্থাপনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। অধ্যাপক ওয়াসির কথায়, “যখন ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হল ও বাহাদুর শাহ জাফরকে গ্রেফতার করে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হল, ভারতীয় মুসলিমরা তখন ভাবলেন ক্ষমতা হাতছাড়া হলেও নিজেদের ধর্মীয় পরম্পরা তো রক্ষা করতে হবে।”
“সেই ভাবনা থেকেই ১৮৬৬র ৩০শে মে দেওবন্দের ছত্তেওয়ালি মসজিদে মাত্র একজন ওস্তাদ ও একজন সাগরেদকে নিয়ে এই মাদ্রাসার জন্ম, ঘটনাচক্রে যাদের দুজনের নামই ছিল মেহমুদ!”
সেদিনের সেই ছোট্ট মাদ্রাসাই আজ মহীরুহের মতো এক বিশাল প্রতিষ্ঠান – যার স্বীকৃতি ও সম্মান গোটা ইসলামী বিশ্ব জুড়ে।
দেওবন্দে আরবি বিভাগে ফাইনাল ইয়ারের বাঙালি ছাত্র জুবায়ের আহমেদ বলছিলেন, “দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সময় মূল ভাবনাটাই ছিল বিশ্বের মাজারে ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা – আর সে লক্ষ্যে আজও এই প্রতিষ্ঠান একশোভাগ সফল!”
তার সতীর্থ, বিহারের কাটিহার থেকে আসা মাশকুর আলম পাশ থেকে যোগ করেন, “স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমাদের উলেমারা এই প্রতিষ্ঠানের ভিত গড়েছিলেন – আর আজও হিন্দুস্তান-সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে এখানকার ছাত্ররা, সারা দুনিয়া আকৃষ্ট হচ্ছে দেওবন্দের প্রতি।”
“ফলে এক কথায় বলা যেতে পারে, দেওবন্দ হল ইসলামের এক ‘মরকজ’ বা কেন্দ্রস্থল।”
আসলে উত্তরপ্রদেশের ওই অখ্যাত শহরেই গত দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে হাদিস আর হানাফিজমের ভিত্তিতে পড়ানো হয়ে আসছে বিশেষ ইসলামী পাঠক্রম, যার নাম ‘দারস-ই-নিজামি’।
বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের বর্তমান প্রধান আহমেদ শফি কিংবা সে দেশের প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ, মরহুম মৌলানা ভাসানিও পড়াশুনো করেছিলেন এই দেওবন্দেই। ভারতেও বদরুদ্দিন আজমল বা মাহমুদ মাদানির মতো রাজনীতিবিদ, কিংবা মালয়েশিয়া-পাকিস্তানের মতো দেশেও অনেক ইসলামী নেতার শিক্ষাদীক্ষা এই প্রতিষ্ঠানেই। কাজেই দেওবন্দের আকর্ষণ যে আন্তর্জাতিক, তা বলার কোনও অপেক্ষা রাখে না।
দারুল উলুমে গবেষণারত, বুলন্দশহরের আবদুল্লা খান যেমন বলছিলেন, “দেখুন, ইসলামী বিশ্বে কায়রো বা মদিনার মতো বড় বড় শিক্ষাকেন্দ্র অনেক আছে। দেওবন্দের পরিসর হয়তো বিশাল না-হতে পারে, কিন্তু এটা হল পাঁউরুটির ওপর মাখনের মতো।”
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দেওবন্দে গবেষণারত আবদুল্লাহ খান কথা বলছেন বিবিসির সঙ্গে “মানে এখানে যে ইসলামী জ্ঞান, শিক্ষার গভীরতা বা আধ্যাত্মিকতার পাঠ আপনি পাবেন তার তুলনা কোথাও মিলবে না!”
পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা দেওবন্দর ছাত্র মুহম্মদ সায়েম আবার বলছেন, “দারুল উলুম দেওবন্দের মূল দৃষ্টিভঙ্গীটাই হল দ্বীন-ই-মাসলাকের সমস্ত ক্ষেত্রে বা সব বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। মানে বাড়াবাড়িও না, ছাড়াছাড়িও না!”
“সেই স্বাভাবিকতা বজায় রেখে ইসলামের মূল ধারার যে চিন্তা, দারুল উলুম আজ অবধি সেটাকেই নিষ্ঠাভরে লালন-পালন করে এসেছে।”
কিন্তু দেশভাগের পরও কীভাবে দেওবন্দ সীমান্তের অন্য পারেও তার আবেদন ধরে রাখতে পেরেছে?
অধ্যাপক আখতারুল ওয়াসি জবাব দেন, “আসলে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পেছনে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতাও সামিল ছিল, সেখানেই এর বিশেষত্ব।”
“করাচি থেকে কামরূপ, সর্বত্রই দেওবন্দী মাদ্রাসার ছড়াছড়ি আর তারাই সেখানে ধরে রেখেছে দেওবন্দের প্রভাব … কারণ যারাই এখান থেকে পড়াশুনো করে বেরোত, তাদের বলা হত নিজের নিজের এলাকায় গিয়ে একই সিলেবাস অনুসরণ করে তোমরাও সেখানে পাঠশালা চালু কর।”
ওদিকে শীতের বিকেলে দেওবন্দে দিনের মতো ক্লাস শেষ হয়, হাজার হাজার ছাত্র শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজেদের ছাত্রাবাসের দিকে হাঁটা দেন। মাগরিবের নামাজের আগে আজানের সুর উত্তরপ্রদেশের এই রুক্ষ জনপদের বাতাস ভরিয়ে তোলে। জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দেওবন্দ কখনও এক পয়সা সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সাহায্য নেয়নি – ফিরিয়ে দিয়েছে রাজা বাদশাহদের অনুদানও। দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতাদের বিধান ছিল সে রকমই। ফলে আজও এই প্রতিষ্ঠান চলে পুরোপুরি সাধারণ মানুষের দানে আর তাদেরই সাহায্যের ভরসায়।
বলা হয়ে থাকে, যে পরিবার দেওবন্দকে সামান্য এক মুঠো চালও দিয়েছে– তাদের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক রয়ে যায় বংশপরম্পরায়, নাড়ির টান থেকে যায় আজীবন। আর সে কারণেই দেশভাগের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল হয়তো বদলে গেছে– কিন্তু বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মুসলিমদের সঙ্গেও দেওবন্দের ইতিহাসের টান অত সহজে ছেড়ার নয়! (সূত্র: বিবিসি বাংলা)