ইসলাম ডেস্ক: পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবী রাসুলকে যুগের প্রেক্ষিতে উম্মতের কল্যাণের জন্য প্রেরণ করেছেন যেমন হযরত ইসা (আ.) এর যুগের উম্মতগণ চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী ছিল, তাই এদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা হযরত ইসা (আ.) কে প্রেরণ করলেন, তিনি জন্মান্ধ লোকের চোখে হাত দিলে, সে চোখ দৃষ্টি ফিরে পেত, কুষ্ঠ রোগীর গায়ে হাতের স্পর্শে কুষ্ঠ রোগ ভালো হয়ে যেত, মৃত লোকদেরকে ডাক দিলে তারা জীবিত হয়ে কথা বলতো, এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা যুগের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে নবীগণকে মু’জিযা প্রদান করেছেন।
বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন, সর্বশেষ নবী ও রাসুল, তার পরে আর কোনো নবী, রাসুল আসবেন না, তাই তার যুগ থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত যে বিষয়ের জ্ঞান পৃথিবীতে বেশী প্রাধান্য বিস্তার লাভ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে সে বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত মু’জিযা প্রদান করেছেন। যেমন রাসুল এর যুগে সাহিত্যের খুব সমাদর ছিল কবি ইমরুল কায়েস, লবীদ, জুহাইর, ও আন্তারা বিন সাদ্দাদ এর মত বিশ্ববিখ্যাত কবিগন রাসুল (সা.) এর সমসাময়িক ছিলেন, যাদের লেখা, কবিতা, কাবা শরীফের দেয়ালে ঝুলানো ছিল। সে যুগকে আরবীতে ‘সাবা আ. মুযাল্লাকা’ এর যুগ বলা হয়।
আল্লাহ তার রাসুলকে এমন একখানি কিতাব প্রদান করলেন যার মোকাবেলায় তামাম আরব বিশ্ব কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, হাজারো প্রচেষ্টায় মক্কার শিক্ষিত কাফেরেরা পবিত্র কোরআনের সুরাতুল কাউসারের মত একটি ছোট সুরা তৈরি করতে পারে নাই। অবশেষে সকলে মাথা নত হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছে এটা কোনো মানুষের কথা নয়; আর রাসুল (সা.) এর উম্মতের একটি বিরাট অংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধি অর্জন করবে এটা আল্লাহ তায়ালা ভালো করেই জানেন। তাই তিনি তার রাসুল (সা.)কে মেরাজের মতো একটি বিস্ময়কর মু’জিযা প্রদান করেছেন, যা চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহ বিজয়ী বিজ্ঞানীদেরকে হতভম্ব করে দিবে।
আজ উম্মতে মুহাম্মদীরা মহাকাশ নিয়ে এমন গবেষণা করছে যা অন্য কোন নবীর উম্মত করে নাই। যদি মেরাজের ঘটনা না ঘটতো তাহলে মহাকাশ বিজয়ের সাফল্যর একক দাবীদার হতো আজকের বিজ্ঞানীরা। আর কতিপয় ধর্মবিমুখ বিজ্ঞানী এ বিষয়ে ধর্মের উপর অপারগতা, অসম্পূর্ণতার কাছে ধর্ম অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ার সম্ভাবনাই দেখা দিতো। তাই আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবকে শুধু মহাকাশ নয় বরং সাত আসমান পার করিয়ে সিদ্রাতুল মুনতাহার পর্যন্ত সফর করিয়েছেন। যা বিজ্ঞানীদের নিকট শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।
কিভাবে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীকে আকাশের লক্ষ কোটি গ্যালাক্সি, ছায়াপথ, নিহারিকাপুঞ্জ, ধুমকেতু, ব্ল্যাক হোল ইত্যাদি পার করিয়ে উর্ধ্ব আকাশে সর্বশেষ স্থানে উপনিত করেছেন। বিজ্ঞানের জয় যাত্রার গোড়ার দিকে কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক মেরাজের সত্যতা নিয়ে কতিপয় প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন :
০১. Gravitational force বা মধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করে কোনো ব্যক্তির পক্ষে উপরে উঠা সম্ভব নয়।
০২. জড় জগতের নিয়ম শৃঙ্খলায় আবদ্ধ স্থূলদেহী মানুষের পক্ষে আকাশের বায়ু শুন্যস্তর ভ্রমন করা অসম্ভব কেনো না মধ্যাকর্ষণ শক্তি স্থুলদেহ সম্পূর্ণ বস্তুকে নিচের দিকে আকর্ষণ করে থাকে।
০৩. বায়ুস্তর পার হওয়ার পর অক্সিজেন থাকে না আর অক্সিজেন ব্যতীত মানুষের পক্ষে বেচেঁ থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং কোনো মানুষের দ্বারা মেরাজ সংঘটিত হওয়া অসম্ভব।
বিজ্ঞানের আশ্চর্য সব তথ্যে ও আলোকে মেরাজের ঘটনা প্রমাণ করা যায় অনায়াসেই। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করে উপরে উঠা সম্ভব নয় প্রাচীন বিজ্ঞানীদের এ ধারণা সঠিক নয়, কেননা গতি বিজ্ঞান dynamics এর তত্ত্বানুসারে- a bullet fired from the earths surface with a speed of 6.90 miles a second or more will fly nito space.[The universe around US] অর্থাৎ পৃথিবী হতে একটি বুলেটকে যদি প্রতি সেকেন্ডে ৬.৯০ অথ্যাৎ প্রায় ৭ মাইল বেগে উর্ধ্ব পানে নিক্ষেপ করা হয় তবে তা মধ্যাকর্ষণ শক্তি ছিন্ন করতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকে (Escap velocity) মুক্ত গতি বলে আর যদি এখানে বুলেটের গতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল হয় তাহলে এখানে (Gravitational force)মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রতিবন্ধকতা আলোচনা নিরর্থক।
কেননা রাসুল (সা.) এর মেরাজ যাত্রা হয়ে ছিল বুরাকে চড়ে। আর বুরাক শব্দটি আরবী (বারকুন) শব্দ থেকে নিঃসৃত। এর শাব্দিক অর্থ বিদ্যুৎ। আর বিদ্যুতের গতি হলো প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। আরবীতে বিদ্যুৎ গতির চাইতে দ্রুত গতি বোঝানোর জন্য অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার হয় নাই। তাই আরবীতে (বারকুন) শব্দের Suparlative dgree হলো বুরাক আর বুরাক শব্দটি ব্যবহার করে বুঝানো হয়েছে যে, বিদ্যুৎ গতির চাইতেও দ্রুতগতি সম্পন্ন বাহনে করে বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উর্দ্ধালোকে গমন করেছিলেন। সুতরাং মেরাজের সফরকে Gravitational force বা মধ্যাকর্ষণশক্তির যুক্তি দিয়ে অসম্ভব বলা অযৌক্তিক।
জড় জগতের নিয়ম শৃঙ্খলায় আবদ্ধ স্থুলদেহী মানুষের পক্ষে আকাশের বায়ুশূন্য স্তর ভ্রমন করা অসম্ভব। অথচ বিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে ভূপৃষ্ঠ হতে কোন স্থূল বস্তুকে যতই উর্ধ্বে প্রেরন করা যাবে, ততই তার ওজন (weight) হ্রাস পাবে, ফলে উর্ধ্বগমন ক্রমেই সহজ হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক Arthure G. Clark তার (The exploration of Space)গ্রন্থে বলেন, ‘As the distance from the earth le ngthens into the thousands of miles. The reduction of gravity be comes substantial’ অর্থাৎ পৃথিবী হতে কোনো বস্তুর দৃরত্ব যতই বৃদ্ধি পাবে সে বস্তুর ওজন ততই হ্রাস পাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা সৃর্যের দৃরত্ব প্রথিবী থেকে ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল উপরে।
সুর্যের চেয়ে কোটি কোটি বিলিয়ন মাইল উপরে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র, যার আলো এখনো পৃথিবীতে এসে পৌঁছেনি যদিও বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর বয়স ১৫০০ কোটি বৎসর। অথচ রাসুল (সা.) এর মেরাজ হয়েছে, এ গ্রহ নক্ষত্র বিশিষ্ট আকাশমণ্ডলীর আরো অনেক পরে। সুতরাং এখানে স্থূল দেহের প্রতিবন্ধকতার প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। বিজ্ঞানীদের মতে অক্সিজেন ব্যতীত মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। অথচ যে আল্লাহ সৃষ্টি জীবকে অক্সিজেনের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখেন, সে আল্লাহ তায়ালা অক্সিজেন ছাড়াও বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। যেমন ইউনূস (আ.) চল্লিশ দিন মাছের পেটে ছিলেন কে তাকে জীবিত রেখে ছিলেন অক্সিজেন ব্যতীত?
এভাবে আমাদের সামনে অনেক ঘটনা রয়েছে, যেমন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় খবর বের হলো একটা ছেলে ৮ ঘন্টা পানির মধ্যে ডুবেছিল কিন্তু সে মরেনি এসব ঘটনা যদি প্রাকৃতিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ জড় জগতে সম্ভব হয় তাহলে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মেরাজুন্নবীতে অক্সিজেন ব্যতীত তার প্রিয় হাবীবকে বাঁচিয়ে রাখা কিভাবে অসম্ভব হতে পারে?
কোনো কোনো বিজ্ঞানি বলেছেন মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের অগ্নি গোলকসমূহকে পাড়ি দেয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং মোহাম্মদ (সা.) এর মেরাজ কিভাবে সম্ভব?
আসলে বিজ্ঞানের যত বেশি আবিস্কার সংঘটিত হচ্ছে পবিত্র কোরআন-হাদিসের কিছু কিছু জিনিসের মর্মার্থ বোঝা ততো সহজ হচ্ছে। কারণ বিজ্ঞান কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু নয়। বরং বিজ্ঞান পবিত্র কোরআনেরই একটি অংশ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, বিজ্ঞানময় কোরআনের শপথ (সুরা ইয়াছিন, আয়াত : ০২)।
মানুষ একসময় মনে করতো পানিতে নামলে ভিজতে হবে এটাই স্বভাবিক, কিন্তু বিজ্ঞান ওয়াটার প্রুফ পোশাক আবিস্কার করে দেখিয়ে দিল যে ওয়াটার প্রুফ পোশাক পরিধান করে পানির মাধ্যে ডুব দিলেও ভিজতে হয় না। অনুরূপভাবে বিজ্ঞানের আর একটি আবিস্কার ফায়ার প্রুফ পোশাক, যা পরিধান করে আগুনের মাঝ দিয়ে চলা ফেরা করা যায়। আগুন কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
যদি দুনিয়ার সাধারণ একজন মানুষের পক্ষে ফায়ার প্রুফ পোশাক পরিধান করে আগুনের মাঝ দিয়ে চলা ফেরা করা সম্ভব হয় তাহলে রাসুল (সা.) এর মত মহামানবের পক্ষে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ ব্যবস্থাপনায় মহাকাশ পাড়ি দেওয়া কি করে অসম্ভব হতে পারে?
পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, পবিত্র মেরাজ অলৌকিক বটে, অযৌক্তিক নয় মুসলমানরা আজ গর্বের সাথে বলতে পারে বৈজ্ঞানিক যত উর্ধ্বে গমন করুক না কেন, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার চেয়ে আরো অনেক অনেক গুণে উর্ধ্বে ভ্রমন করেছেন। মেরাজ মুসলমানদেরকে আল্লাহ তায়ালার আশ্চর্য সব সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে শেখায়, গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ কারণেই বর্তমানে পবিত্র মেরাজকে নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
মোহাম্মদ মোবারক হোসাইন : তরুণ গবেষক ও সঙ্গীত শিল্পী।