আহমদ আবদুল্লাহ: শাবান মাসের বরকত অনেক। এর অন্যতম কারণ হল, এ মাসের ১৪তম তারিখ দিবাগত রাতেই হয়ে থাকে বিশ্বসৃষ্টির মুক্তি ও ভাগ্য নির্ধারণের বরকতপূর্ণ রজনি ‘শবেবরাত’ বা লাইলাতুল বরাত। এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে এবং ইবাদতের ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে রাসূল (সা.) বলেন, যখন শাবান মাসের অর্ধেকের রজনি আসে (শবেবরাত) তখন তোমরা রাতে নামাজ পড়ো, আর দিনের বেলা রোজা রাখো। নিশ্চয় আল্লাহ এ রাতে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আসমানে এসে বলেন, কোনো গোনাহ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি আমার কাছে? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দেব। কোনো বিপদগ্রস্ত মুক্তি পেতে চায় কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দেব। আছে কি এমন, আছে কি তেমন? এমন বলতে থাকেন ফজর পর্যন্ত (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।
এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি করা নির্ভরযোগ্য হাদিসে প্রমাণিত। তাই রাসূল (সা.) ও সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে আজও এ রাতে বিশেষ নফল ইবাদত বন্দেগির ধারাবাহিকতা চলে আসছে। হজরত আয়শা (রা.) বলেন, এক রাতে রাসূলকে (সা.) না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়শা? তুমি যে তালাশে বের হলে? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? তোমার পাওনা রাতে অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়ে রাত্রিযাপন করবেন? হজরত আয়শা (রা.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল (সা.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ রাত আসে অর্থাৎ যখন শবেবরাত হয়, তখন আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন (সুনানে তিরমিজি : ৭৩৯)।
এ মাস এলে প্রিয়নবী (সা.) এর আমলের ধারা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বাড়িয়ে দিতেন। উম্মুল মু’মিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূল (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমার আশঙ্কা হল, তাঁর হয়তো ইন্তেকাল হয়ে গেছে। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা! (অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা!) তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা।
নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি তখন বললেন, এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই (বায়হাকি ৩/৩৮২,৩৮৩)। এই হাদিস থেকে এ রাতের মর্যাদা যেমন জানা যায় তেমনি এ রাতের আমল কেমন হওয়া উচিত তাও বোঝা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘ নামাজ পড়া, সেজদা দীর্ঘ হওয়া, দোয়া ইস্তেগফার করা এ রাতে জরুরি।
হাদিসে এ রাতকে বলা হয়েছে, ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবানের অর্ধ মাসের রাত। আবার কোথাও বলা হয়েছে ‘লাইলাতুল বরাত’ বা মুক্তির রজনি। হজরত জালালুদ্দিন মহল্লি (রাহ.) এ রাতের আরও দুটি নামের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে, ক. ‘লাইলাতুল রাহমাত’ বা করুণার রাত। খ. ‘লাইলাতুস সাফ’ বা চুক্তিনামার রাত (জালালাইল : ২/৪১০)। কারণ, এ রজনিতে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি পরম দয়াময়ের পক্ষ থেকে তার অপার করুণার বান বয়ে যায় এবং মানুষের জীবন-মরণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে অজস্র চুক্তিনামা বা দলিলাদি স্বাক্ষরিত হয়। এ রাতকে শাফায়াতের রাতও বলা হয়। লাইলাতুল বরাত মর্যাদাপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক বরকত নাজিল হয়। অসংখ্য নেকি দান করা হয়। অনুগ্রহ ও দয়ার ভাণ্ডার খুলে দেয়া হয়। গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হয়। বিশেষ করে এ রাত গুনাহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হয়।
মানবজাতিকে সৃষ্টি করে কিভাবে চলতে হবে এবং কী কী আমল করতে হবে এবং কোন কোন কাজ দূর করতে হবে তা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। তবুও মানুষ শয়তানের ধোকায় পড়ে অনেক পাপ করে থাকে। আল্লাহ বড়ই দয়ালু। তিনি চান অপরাধ করার পর বান্দাদের একটি সুযোগ দিতে, যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে তাওবা করে। তাই তারা যদি এই রাতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। আর এ জন্য রাতটি ক্ষমা প্রার্থনার রাত। সুতরাং পাপী পারে এ রাতে ক্ষমা চেয়ে নিতে রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে।
শবেবরাত ও শবেকদরের বরকতে সগিরা গুনাহ মাফ হয় বটে; তবে যে কোনো গুনাহ থেকে ক্ষমা পেতে হলে খাঁটি মনে তাওবা করতে হবে। এ বরকতময় রাতে যেন আমরা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতে পারি, কোরআন তেলাওয়াত করতে পারি, দেশ-জাতি ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য দোয়া করতে পারি, আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমিন!
আহমদ আবদুল্লাহ : শিক্ষক, রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া, ঢাকা