অধ্যক্ষ সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আবদুল্লাহ জাফরী : রোজা পরিপালন এবং কুরআন অবতীর্ণকরণ কুরআনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আল্লাহ তায়ালা রোজা সম্পর্কে মুমিনদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করেছেন, ‘হে ঈমানদার সমাজ! তোমাদের ওপর সিয়াম (রোজা) পরিপালন বিধিবদ্ধ করা হলো, যেমনটি বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল তোমাদের অগ্রজদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সূরা আল বাকারা-১৮৩)
সুব্হে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইবাদাতের উদ্দেশ্যে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। এ রোজা ফরজ করা হলো এ জন্য যে, রোজা পরিপালনকারী তাকওয়া অর্জন করতে পারবেন। অর্থাৎ রোজার মূল লক্ষ্য হলো তাকওয়া এবং কর্মকৌশল হলো সুব্হে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ইবাদতের নিয়তে পানাহার ও যৌনাচার বর্জন।
তাকওয়া বলতে কী বুঝায় তা উপলব্ধি করা যায় দু’জন সম্মানিত সাহাবির কথোপকথন থেকে। খলিফাতুল মুমিনীন হজরত উমার রা: হজরত উবাই ইবনে কা’ব রা:-কে মদিনায় তারাবি জামাতের ইমাম নিয়োগ করেছিলেন। তিনি উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানীদের একজন ছিলেন, তাকে হজরত উমার রা: জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বলতে পারো, তাকওয়া বলতে কী বুঝায়?’ তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি কখনো জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু পথে যাতায়াত করেছেন, যে পথের দু’দিক থেকে উদ্ভিদের কণ্টকযুক্ত শাখা-প্রশাখা ঝুঁকে রয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এ ধরনের পথে আমি যাতায়াত করেছি।’ হজরত উবাই রা: জানতে চাইলেন, ‘কিভাবে আপনি যাতায়াত করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘আমার দেহের পোশাক আঁটসাঁট করে সাবধানে পথ অতিক্রম করেছি, যেন লতাগুল্মের কাঁটা আমার পোশাককে আঁকড়ে না ধরে।’ হজরত উবাই রা: বললেন, ‘এটাই তো তাকওয়া।’
কণ্টকের অর্থ হলো, হারামের লোভনীয় হাতছানি। মহান আল্লাহ যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন, তা জীবন পরিক্রমায় মনোমুগ্ধকর-চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে আকর্ষণ করবে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নিষিদ্ধ করেছেন- এ চেতনা জাগ্রত রেখে পার্থিব জীবনচর্চা করতে হবে। বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিচার করলে অনুভূত হয় কণ্টকের অনিষ্টতা থেকে মুক্ত থাকা অর্থাৎ হারাম থেকে দূরে অবস্থান করা। আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে মূল যে বিষয়টি প্রতিভাত হয় তা হলো, পথ অতিক্রম করা বা মূল লক্ষ্যপানে পৌঁছে যাওয়া। সুতরাং উদ্দেশ্য হলো, নিজকে কণ্টকের অনিষ্টতা থেকে মুক্ত রাখা এবং লক্ষ্য হলো, গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাওয়া।
নেতিবাচক বিষয়গুলো হচ্ছে, মহান আল্লাহ যেসব কথা বলতে, কর্ম করতে ও আচরণ দ্বারা প্রকাশ করতে নিষিদ্ধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা। রোজা পালন করে তাকওয়া অর্জনের বিষয় হলো, ‘আমি জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা কথন-লিখন, অন্যায় আচরণ, সুদ-ঘুষ, হত্যা, ধর্ষণ, ব্যভিচার, পরস্বার্থহরণ, আত্মসাৎ, আচরণে বা ধর্মের নামে চরমপন্থা অবলম্বন, কালোবাজারি, মজুদদারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে শোষণ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ ও রাসায়নিকের অপব্যবহার, অবৈধ উপার্জন, অশ্লীল কথা ও আচরণ, অশালীন পোশাক পরিধান, ওজনে কম দেয়া তথা সব অন্যায় কর্ম থেকে নিজকে বিরত রাখব এবং অন্যকে বিরত রাখার জন্য চেষ্টা করব।’
আল্লাহ তায়ালা অন্যায় কর্ম থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন, তাঁর আদেশ প্রতিপালনের মূল লক্ষ্য হলো, তাঁর ইবাদত করা। আর ইবাদতের অর্থ হলো, পার্থিব জীবন পরিক্রমায় মহান আল্লাহর সব আদেশ-নিষেধ শিরোধার্য করে রাসূল সা:-এর নির্দেশিত পন্থায় সাধ্যানুযায়ী আল্লাহরই দাসত্ব করা। আর এ বিষয়টি হলো ইতিবাচক, অর্থাৎ তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর বিধানে নিষিদ্ধ কর্মসমূহ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে জীবনচর্চা করা। অর্থাৎ নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং আদিষ্ট কাজ সাধ্যানুযায়ী সম্পাদন করা, সংক্ষেপে একেই বলে ‘তাকওয়া’।
নবী করীম সা: বলেছেন, আমি তোমাদের যেসব কাজ থেকে বিরত থাকার আদেশ দিই, তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকবে। আর যেসব কাজ করতে আদেশ করি, তা সাধ্যানুযায়ী সম্পাদন করবে (মুসলিম হা/১৩৩৭)। এখন আমাদের জানতে হবে, আল কুরআনের সাথে তাকওয়ার সম্পর্ক কী। এ সম্পর্কে আল কুরআন জানাচ্ছে, ‘এটি সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত’ (সূরা আল বাকারা-২)।
রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা সম্পর্কিত আয়াতে বলা হয়েছে, ‘কুরআন জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য হিদায়াত এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট দলিল এবং সত্য-মিথ্যার (নির্ণায়ক) পার্থক্যকারী। কিন্তু সূরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতেই বলা হলো, ‘এ কিতাব মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত বা পথনির্দেশনা।’ শর্ত দেয়া হয়েছে, কুরআন থেকে পথনির্দেশনা পেতে হলে ব্যক্তিকে অবশ্যই ‘মুত্তাকি’ হতে হবে। মহান আল্লাহর বিধানের কাছে নিজকে সমর্পণপূর্বক ব্যক্তিকে ঈমানদার হতে হবে এবং যাবতীয় দুষ্কর্ম থেকে নিজকে মুক্ত রেখে কুরআনভিত্তিক জীবন চর্চা করতে হবে। তাহলে এ কুরআন তাকে অভ্রান্ত পথে পরিচালিত করবে এবং রোজা যে তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে ফরজ করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যও পূর্ণ হবে। আর এটাই হচ্ছে সংক্ষেপে ‘তাকওয়া’র সংজ্ঞা। প্রশ্ন হতে পারে, একবার বলা হলো কুরআন সব মানুষের জন্য। আবার এ কথার বিপরীতে বলা হচ্ছে, কুরআন মুত্তাকিদের জন্য। বিষয়টি কি সাংঘর্ষিক নয়?
নিঃসন্দেহে এটা পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা বিষয়টি এভাবে অনুধাবন করতে হবে, কুরআন নীতিগতভাবে সব মানুষের জন্য হলেও সব মানুষ কুরআনের জন্য নয়। কুরআন থেকে পথনির্দেশনা লাভের জন্য ব্যক্তিকে স্বীয় অভ্যন্তরে সেই যোগ্যতা সৃষ্টি করতে হবে, যে যোগ্যতা ব্যক্তির অভ্যন্তরে বিদ্যমান থাকলে পথনির্দেশনা গ্রহণ করা যাবে। এ কিতাব যে সব বিষয়ে ঈমান পোষণের নির্দেশ দেয়, সে বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ়তার সাথে ঈমান পোষণ করতে হবে, তাহলে কুরআন থেকে হিদায়াত পাওয়া যাবে।
মহান আল্লাহ সব মানুষকে সৃর্ষ্টি করেছেন, কিন্তু সম্মান-মর্যাদার দিক দিয়ে মুত্তাকিদের প্রথম শ্রেণীর মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো কিছু অর্জন করতে হলে ব্যক্তিকে কাক্সিক্ষত মান অবশ্যই অর্জন করতে হয়। প্রয়োজনীয় মান অর্জন না করে ব্যক্তির পক্ষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র। রোজা ফরজ করা হয়েছে রোজা পালনকারীর মধ্যে ‘তাকওয়া’ সৃষ্টির লক্ষ্যে, যেন ব্যক্তি কুরআন থেকে দিকনির্দেশ গ্রহণপূর্বক নিজেকে মুত্তাকি হিসেবে গড়তে পারে।
সুতরাং ‘কুরআন সব মানুষের জন্য’ এবং ‘কুরআন মুত্তাকিদের জন্য পথনির্দেশনা’- আল কুরআনের এ কথা পরস্পরবিরোধী বা সাংঘর্ষিক নয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, সূর্য-কিরণে বস্তুনিচয় উদ্ভাসিত হয় এবং মানুষ তা দেখতে পায়। কিন্তু সূর্যের আলোয় কি সব মানুষই দেখতে পায়? যাদের দৃষ্টিশক্তি নেই তারা বস্তুনিচয় দেখতে পায় না; এমনকি নিজ দেহও দেখতে পায় না। সূর্যের আলো দেখার জন্য ব্যক্তিকে দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হতে হবে। ব্যক্তি দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন না হওয়া সূর্যের অযোগ্যতা নয়। সূর্য আলো বিকিরণ করছে অথচ দৃষ্টিশক্তি না থাকার কারণে ব্যক্তি এ আলো কাজে লাগিয়ে পথের দিশা সন্ধান করতে অক্ষম হচ্ছে।
অনুরূপভাবে কুরআন সব শ্রেণীর মানুষের জন্য গাইডবুক হলেও ‘তাকওয়া’ নামক যোগ্যতার অভাবে ব্যক্তি তা থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করতে পারছে না। আর তাকওয়া বলতে কী বুঝায়, তা ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ঈমান পোষণকারী লোকদের প্রতি রোজা বিধিবদ্ধ করেছেন তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে। রমজান মাস পেয়েও যদি আমরা তাকওয়া অর্জনে অক্ষমতার পরিচয় দিই, তাহলে এটি হবে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হিসেবে আমাদের সব থেকে বড় ব্যর্থতা। আর এ ব্যর্থতা আমাদের পার্থিব জীবনে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি আখিরাতের ময়দানে চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ মাস কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হাদিসগুলো অধ্যয়ন করলে উপলব্ধি করা যায়। হজরত আবু হুরাইরা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন রমজান মাস শুরু হয়, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়’ (বুখারি হা/১৮৯৮)। ‘যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা পালন করবে, তার অতীতের অপরাধসমূহ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারি হা/১৯০১)। রাসূল সা: বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের সব কাজই তার নিজের জন্য, রোজা শুধুমাত্র আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেবো’ (বুখারি হা/১৯০৪)।
হজরত সাহ্ল ইবনু সা’দ রা: বর্ণনা করেন, নবী করীম সা: বলেছেন, ‘রাইয়ান নামক জান্নাতের একটি দরজা আছে। কিয়ামতের দিন রোজাদারেরা এ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তারা ব্যতীত অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। আহ্বান করা হবে, ‘রোজাদারেরা কোথায়?’ তারা উঠে দাঁড়াবেন, তারা ব্যতীত অন্য কেউই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাদের প্রবেশের পরই তা বন্ধ করে দেয়া হবে, যেন ওই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে না পারেন’ (বুখারি হা/১৮৯৬)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘নবী করীম সা: মানবজাতির মধ্যে সব চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমজানে হজরত জিবরাঈল আ: যে সময় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন, সে সময় তিনি অধিক দানশীল হতেন। জিবরাঈল আ: রমজানে প্রতি রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল সা: তাঁকে কুরআন পড়ে শুনাতেন’ (বুখারি হা/১৯০২)।
মনে রাখতে হবে, এ মাসে তাকওয়া অর্জনের সুযোগ দিয়ে মহান আল্লাহ আমাদের বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত দান করেছেন। অন্য মাসে একটি সৎ কর্মের বিনিময় বৃদ্ধি করে দশগুণ করা হয়েছে। কিন্তু এ মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে বিধায় এ কিতাবের ওসিলায় এ মাসে একটি সৎ কর্মের বিনিময় সত্তর থেকে সাত শত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর পরও মহান আল্লাহ জানিয়েছেন, বান্দা আমার কাছে চাইলে আমি আরো বৃদ্ধি করে দেবো।
অতএব আমরা যেন আগ্রহ, ঐকান্তিকতা, একাগ্রতা ও নিষ্ঠাসহকারে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট এবং যতœবান হই। আমরা জানি না, আগামী রমজান মাস আমাদের নসিবে আসবে কিনা। সুতরাং আল কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার এ মাসে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই যে, আমরা কুরআন তিলাওয়াত করব। তবে তিলাওয়াতের মধ্যেই কুরআনকে সীমাবদ্ধ রাখব না। এ কিতাবকে আমরা অনুধাবনপূর্বক আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন করব।
কুরআন-সুন্নাহতে উল্লেখ করা বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব। এ জন্য মহান আল্লাহ পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদের অনুকূল করে দিন; আমরা তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা ভিক্ষা চাই এবং তিনি আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন।