ইসলাম ডেস্ক: আল্লাহ তাআলা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধির এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম রোজাকে বান্দার জন্য নির্ধারণ করেছেন। রোজা মানুষের গুনাহমাফের মাধ্যমে বান্দাকে নিষ্পাপ ও নির্ভেজাল করে। শাওয়াল মাসের ছয়টি নফল রোজা সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব এনে দেয়। মুসলমানররা একমাস কষ্ট করে রোজা পালন করতে পারলে নিশ্চয় ছোট্ট এই কাজটিও করতে পারবে। হজরত আবু আইয়ুব (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল অতঃপর তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল সে যেন পূর্ণ বছরই রোজা রাখল।’ (মুসলিম: ১১৬৪)।
একজন মানুষের জীবন সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে যাপনের জন্য যে ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট্যের প্রয়োজন, রোজা তা সৃষ্টি করে। একজন ব্যক্তি যখন রমজান মাসের রোজা রেখে তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসেও ছয়টি রোজা পালন করল, সে এই রোজার কারণে আল্লাহর দরবারে পূর্ণ একটি বছর রোজা রাখার সমান সওয়াব পেয়ে গেল। হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য, আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান; এ হলো এক বছরের রোজা।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা শেষ করে ছয় দিন রোজা রাখবে সেটা তার জন্য পুরো বছর রোজা রাখার সমতুল্য।’ (আহমাদ: ৫/২৮০, দারেমি: ১৭৫৫)
এমন অনেক হাদিস রয়েছে যার দ্বারা শাওয়ালের ছয়টি নফল রোজা রাখার ফজিলত প্রমাণিত হয়। মাহে রমজানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের মধ্যে ছয়টি রোজা রাখার এই আমলটা কতই না সহজ, কিন্তু এর ফজিলত কতই না মহান। কারও পক্ষে সহজেই সম্ভব নয় এক বছর লাগাতার রোজা রাখা। অথচ এই আমলটা বিরাট ফজিলতসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব। নিয়ত পরিষ্কার রেখে যেকোনো নেক আমলের চিন্তা করা ও সৎকাজে অগ্রসর হওয়া ইবাদতের শামিল। এর জন্য শুধু মনের সহিহ নিয়ত ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসুলুল্লাহ (সা.) কে সারা বছর রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে তোমার ওপর তোমার পরিবার-পরিজনের হক বা অধিকার রয়েছে। অতঃপর তিনি বললেন, ‘মাহে রমজানের এবং তার পরবর্তী দিনগুলোরও প্রত্যেক বুধবার ও বৃহস্পতিবারে রোজা রাখবে। সুতরাং যখন তুমি এই রোজাগুলো রাখবে তখন যেন তুমি সারাটা বছরই রোজা রাখলে।’
বান্দার ওপর আল্লাহর কতই না পরম দয়ালু ও অশেষ মেহেরবান যে তিনি অল্প আমলের বিনিময়ে অধিক সওয়াব দেবেন। বান্দা যখন প্রকৃতভাবে স্রষ্টাকেই ভালোবাসে তখন তার জন্য একদম কঠিন থেকে কঠিনতম আমলও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অগ্রসর হয়, আল্লাহর অশেষ রহমত তার দিকে দৌড়িয়ে অগ্রসর হয়। বান্দা যখন আল্লাহর প্রেমে বিভোর হয়ে তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সামান্যতম আমল তাঁর দরবারে পেশ করে, আল্লাহ তখন বান্দার এই আমলকে দশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহর এই দয়া ও অনুগ্রহ বান্দা তখনই লাভ করবে যখন বান্দা নেক আমল করবে। কেননা আল্লাহর রহমত লাভের জন্য একটি অছিলা আবশ্যক। আর তা হলো নেক আমল। তাই তো বান্দা যেন আল্লাহর রহমতকে হাতছাড়া না করে। বরং অল্প নেক আমলের বিনিময়েই যেন সে আল্লাহর অফুরন্ত দয়া ও অশেষ অনুগ্রহের অধিকারী হয়ে যায়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘কেউ কোনো সৎকর্ম করলে সে তার দশ গুণ পাবে এবং কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু তারই প্রতিদান দেওয়া হবে।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৬) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘অনন্তর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সূরা আয-যিলযাল, আয়াত: ৭-৮)
আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে মানব জাতিকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তা চান বান্দা যেন সর্বদা ইবাদত-বন্দেগি করে। এমন অনেক পথই আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য খোলা রেখেছেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) উম্মতের সামনে তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। অল্প নেক আমলের বিনিময়ে আল্লাহর অসীম দয়া ও অনুগ্রহের পাত্র হওয়ার জন্য নবী করিম (সা.) কর্তৃক বর্ণিত সহজ পন্থাসমূহ থেকে একটি অতি সহজ পন্থা হলো শাওয়াল মাসের ছয়টি নফল রোজা। বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এই ছয়টি নফল রোজা রাখবে তখন আল্লাহ তাকে পূর্ণ একটি বছর রোজা রাখার সওয়াব দিয়ে দেবেন। কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতাস্বরূপ শাওয়ালের ছয়টি নফল রোজার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা মুস্তাহাব।
মহান শরিয়তপ্রণেতা আল্লাহর রাসুল (সা.) ফরজের আগে-পরে সুন্নত ও নফল প্রবর্তন করেছেন। যেমন ফরজ নামাজের পূর্বাপর সুন্নতগুলো এবং মাহে রমজানের আগে শাবানের ঐচ্ছিক রোজা আর পরে শাওয়ালের নফল রোজা। এই নফল ইবাদতগুলো ফরজের ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণ করে। কারণ রোজাদার কখনো অনর্থক বাক্যালাপ, কুদৃষ্টি প্রভৃতি খারাপ কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বাঁচতে পারে না যা তার রোজার পুণ্য কমিয়ে দেয়। একজন মুমিন রোজাদার যদি মিথ্যাচার, পরচর্চা, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতারণা, মোনাফেকি, অসাধুতা, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতিপরায়ণতা, আত্মকলহ, ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি সামাজিক অনাচার জাতীয় গর্হিত ও অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিহার করে আত্মসংযমী হয় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, সহিহ শুদ্ধভাবে ফরজ ও নফল রোজা পালন এবং পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ, তওবা, ইস্তেগফার—এসব ইবাদতের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেন, তা হলে নিঃসন্দেহে তিনি পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একজন খাঁটি আবেদ বা প্রিয় মকবুল বান্দা হিসেবে গণ্য হবেন। সুতরাং আসুন, আমরা এই মহান ফজিলত ও বরকতময় শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোজা পালনের নেক আমলটি নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের শাওয়াল মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখার মাধ্যমে সারা বছর রোজা পালনের সওয়াব হাসিলের দ্বারা ইহকাল ও পরকালে সফলকাম হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/