ইসলাম ডেস্ক: পবিত্র কোরআন মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার বাণী। যা মানুষের প্রয়োজনের জন্য নাজিল করা হয়েছে। পাশাপাশি আল্লাহ শুরুতেই এর সত্যায়ন করেছেন যে, এ কিতাবে কোনো সন্দেহ সংশয় নেই।
কোরআনের মধ্যে এমন কোনো কিছু নেই যা মানবজাতির কল্যাণে লিপিবদ্ধ হয়নি। এ জন্যই আল্লাহ এ কোরআনকে মানব জাতির হিদায়াত ও জীবন বিধান হিসেবে নাজিল করেছেন। ‘আয়াতুল কুরসি’ আল্লাহ তায়ালার অপূর্ব দান।
পাঠকদের জন্য আজ আয়াতুল কুরসির ফজিলত তুলে ধরা হলো-
আয়াতুল কুরসি কোরআনুল কারিমের সবচেয়ে বড় সূরা ‘সূরা আল-বাক্বারার ২৫৫ তম আয়াত’। যা সমগ্র কোরআনের সবচেয়ে বড় আয়াতও বটে। এ সূরার রয়েছে অনেক ফজিলত।
এর ফজিলত সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত ওবাই ইবনে কা’বকে জিজ্ঞাস করলেন সবচেয়ে ফজিলত ও গুরুত্বপূর্ণ আয়াত কোনটি? ওবাই ইবনে কা’ব আরজ করলেন, সেটি হচ্ছে আয়াতুল কুরসি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা সমর্থন করলেন এবং বললেন, হে আবুল মানজার! তোমাকে এ উত্তম জ্ঞানের জন্য ধন্যবাদ। (মুসনাদে আহমদ)
আয়াতুল কুরসির ফজিলত:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক ফরজ সালাত শেষে আয়াতুল কুরসি পাঠকারীর জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য আর কোনো বাধা থাকে না মৃত্যু ব্যতিত। (নাসাঈ)
শয়নকালে পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত তার হেফাজতের জন্য একজন ফেরেশতা পাহারায় নিযুক্ত থাকে। যাতে শয়তান তার নিকটবর্তী হতে না পারে। (বুখারি)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আয়াতুল কুরসি কোরআনের অন্যসব আয়াতের সর্দার বা নেতা। আয়াতটি যে ঘরে পড়া হবে, সে ঘর থেকে শয়তান বের হয়ে যাবে।
যে লোক প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি তিলাওয়াত করবে, তার জন্য বেহেশতে প্রবেশের একমাত্র বাধা হচ্ছে মৃত্যু। অর্থাৎ সে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বেহেশতের ফলাফল ও আরাম আয়েশ ভোগ করতে থাকবে।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু একদিন দেখতে পেলেন একজন আগন্তুক সদকার মাল চুরি করতেছে তখন তিনি আগন্তুকের হাত ধরে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে যাব’। তখন আগন্তুক বলে যে সে খুব অভাবি আর তার অনেক প্রয়োজন। তাই দয়া করে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে ছেড়ে দিলেন।
পরদিন সকালে রাসূল রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে আসার পর তিনি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘গতকাল তোমার অপরাধী কী করছে?’ হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন তাকে ক্ষমা করার কথা বললেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘অবশ্যি সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে।’
পরদিন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু অপেক্ষায়, যখন সে আবারো চুরি করতে আসল তখন তিন তাকে পাকড়াঁও করলেন আর বললেল, ‘এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে যাব।’ এবারও সেই বলে যে- সে খুব অভাবি আর তার অনেক প্রয়োজন আর শপথ করে যে আর আসবে না। পরদিন আবারো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি একই জবাব দেন আর তখন তিনি বলেন, ‘আসলেই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে।’
পরদিনও আবার হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু চোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন আর যখন সে আবারো চুরি করতে আসল তখন তিনি তাকে পাকড়াঁও করলেন আর বললেন ‘এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে যাব। তুমি বার বার শপথ করো আর চুরি করতে আসো।’ সে যখন দেখল এবার সে সত্যিই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে যাবে তখন অবস্থা বেগতিক দেখে সে বলে, ‘আমাকে মাফ কর।
আমি তোমাকে এমন কিছু বলে দিব যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দান করবেন।’ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটা জানতে চাইলে চোর বলে, ‘যখন ঘুমাতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাবে তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য একজন পাহাড়াদার নিযুক্ত করবে, যে তোমার সঙ্গে থাকবে আর কোনো শয়তান সকাল পর্যন্ত তার কাছে আসতে পারবে না।’ এটা শুনে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে ছেড়ে দিলেন।
পরদিন রাসূল রাদিয়াল্লাহু আনহু আবার অপরাধীর কথা জানতে চাইলে তিনি আগের রাতের কথা বললেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘যদিও সে চরম মিথ্যাবাদী কিন্তু সে সত্য বলেছে’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ‘তুমি কি জানো সে কে?’ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন,‘না’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন , ‘সে হচ্ছে শয়তান।’ (বুখারি)
আয়তুল কুরসী: اَللهُ لآ إِلهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّوْمُ، لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَّلاَ نَوْمٌ، لَهُ مَا فِى السَّمَاوَاتِ وَمَا فِى الْأَرْضِ، مَنْ ذَا الَّذِىْ يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ، يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيْهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيْطُوْنَ بِشَيْئٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلاَّ بِمَا شَآءَ، وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ، وَلاَ يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَ هُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيْمُ-
বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম। লা তা’খুযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাঊম। লাহূ মা ফিস্ সামা-ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্বি। মান যাল্লাযী ইয়াশফাউ’ ই’ন্দাহূ ইল্লা বিইজনিহি। ইয়া’লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খালফাহুম, ওয়ালা ইউহিতূনা বিশাইয়্যিম্ মিন ‘ইলমিহি ইল্লা বিমা শা-আ’ ওয়াসিআ’ কুরসিইয়্যুহুস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বি, ওয়ালা ইয়াউ’দুহূ হিফযুহুমা ওয়া হুওয়াল ‘আলিইয়্যুল আ’জিম। (সূরা আল-বাক্বারা আয়াত-২৫৫)
অর্থ: আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক। কোনো তন্দ্রা বা নিদ্রা তাঁকে পাকড়াও করতে পারে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁরই মালিকানাধীন। তাঁর হুকুম ব্যতিত এমন কে আছে যে, তাঁর নিকটে সুফারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি জানেন।
তাঁর জ্ঞানসমুদ্র হতে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, কেবল যতুটুকু তিনি দিতে ইচ্ছা করেন তা ব্যতিত। তাঁর কুরসি সমগ্র আসমান ও জমিন পরিবেষ্টন করে আছে। আর সেগুলোর তত্ত্বাবধান তাঁকে মোটেই শ্রান্ত করে না। তিনি সর্বোচ্চ ও মহান’।
আয়াতের মর্যাদার কারণ: এ আয়াতটিতে ১০টি বাক্য রয়েছে। যার প্রত্যেকটি আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি, গুনাবলি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে-
১. তিনিই আল্লাহ যিনি ব্যতিত ইবাদতের উপযুক্ত আর কোনো ইলাহ নেই। ২. আলহাইয়্যুল কাইয়্যুম- তিনি সদা জীবিত এবং বিদ্যমান। ৩. লা তা’খুজুহু সিনাতুও ওয়ালা নাউম- আল্লাহ তায়ালা তন্দ্রা ও নিন্দ্রা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
৪. লাহু মা ফিসসামাওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদ্বি- আকাশ এবং জমিনের যা কিছু রয়েছে তার সবাই আল্লাহর মালিকানাধীন ৫. মানজাল্লাজি…বিইজনিহি- সৃষ্টি কোনো বস্তুই আল্লাহর চেয়ে বড় নয় বিধায় এমন কে আছে যে তাঁর সামনে তাঁর অনুমতি ব্যতিত সুপারিশ করতে পারে?
৬. ইয়া’লামু… খালফাহুম- মানুষের জন্মের পূর্বে এবং জন্মের পরের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা জানেন। ৭. ওয়ালা ইউহিতুনা…বিমাশা আ- সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান মিলে একত্রিত হয়ে আল্লাহর জ্ঞানের কোনো একটি অংশ বিশেষকেও পরিবেষ্টিত করতে পারে না।
৮. ওয়াসিআ’… ওয়াল আরদ্বি- তাঁর কুরসি এতো বড় যে, সাত আসমান ও সাত জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। ৯. ওয়া লা ইয়াউদুহু হিফজুহুমা- আল্লাহর নিকট এত বৃহৎ দুইটি সৃষ্টি আসমান-জমিনের হেফাজত করা কোনো কঠিন কাজ নয়।
১০. ওয়া হুয়াল আলিয়্যুল আজিম- তিনি অতি উচ্চ এবং অতি মহান। এই পুরো আয়াতটিই আল্লাহর একত্ববাদ ও মর্যাদার গুণগান বিধায় আল্লাহ এ আয়াতের মধ্যে অনেক ফজিলত রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আয়াতুল কুরসির আমল করার এবং কোরআন অনুযায়ী জীব্ন যাপন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।