মুফতি মুহম্মদ রফিকুল ইসলাম: হিজরি সালের ১২তম মাস জিলহজ। এই মাস চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম। এটি হজের মাস, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার মাস, প্রভুর সান্নিধ্য লাভের মাস। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস ১২টি; এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস, এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
এ মাসের ফজিলত ও মর্যাদা প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত আছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও না। তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করল এবং কিছুই নিয়ে ফিরতে পারেনি। (বুখারি) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে একজন মুমিনের কর্তব্য হলো, পুণ্য কাজের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই ১০ দিন অতিবাহিত করা। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহর কাছে ইবাদতের জন্য জিলহজের ১০ দিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোনো দিন নেই। জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাও কি এর সমান নয়? মহানবী (সা.) প্রত্যুত্তরে বলেন, না। তবে যদি জিহাদে কারো ঘোড়া আহত হয় এবং স্বয়ং মুজাহিদ ধূলি-মলিন হয়, তবে তার জিহাদ উল্লিখিত দিনগুলোর আমলের সমান হতে পারে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা দিবসসমূহের মধ্যে চারটি দিবসকে সম্মানিত করেছেন—জুমাবার, আরাফার দিন, ঈদুল আজহার দিন এবং ঈদুল ফিতরের দিন। তদ্রূপ চারটি মাসকে মর্যাদাপূর্ণ করেছেন—১. জিলকদ, ২. জিলহজ, ৩. মহররম ও ৪. রজব।
রোজা রাখা: ইমাম নববী (রা.) বলেন, এ মাসের প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। বিশেষ করে, যে ব্যক্তি হজে যায়নি তার জন্য আরাফার দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক যুবকের অভ্যাস ছিল, সে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা দিলেই রোজা রাখত। মহানবী (সা.) তা জানতে পেরে যুবককে জিজ্ঞেস করেন, হে যুবক! তুমি কেন এ দিনগুলোতে রোজা রাখো? সে প্রত্যুত্তরে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, এ দিবসসমূহ পবিত্র হজের প্রতীক ও হজ আদায়ের মুবারক সময়। হজ আদায়কারীর সঙ্গে আমিও নেক আমলের আশায় অংশীদার হই, তার সঙ্গে আমার দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করে নেবেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার একেকটি রোজার বিনিময়ে ১০০ দাস আজাদ করার, ১০০ উট দান করার এবং জিহাদের সাজে সজ্জিত একটি ঘোড়া জিহাদের জন্য দান করার সওয়াব হবে। আরাফাতের দিন তথা জিলহজের রোজার বিনিময়ে দুই হাজার দাস মুক্ত করার, দুই হাজার উট দান করার, জিহাদে সজ্জিত দুই হাজার ঘোড়া দান করার পুণ্যপ্রাপ্ত হবে। (মুকাশাফাতুল কুলুব, ইমাম গাজ্জালি) অন্য হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, আরাফাতের দিন তথা ৯ জিলহজের রোজা দুই বছর রোজা রাখার সমতুল্য আর আশুরার রোজা এক বছর রোজা রাখার সমতুল্য।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আর আমি হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে ৩০ রাতের অঙ্গীকার করেছি এবং তা পূর্ণ করেছি আরো ১০ দ্বারা। (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৪১)
মুফাসসিরদের মতে, সেই ১০ দিন ছিল জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ দিবসসমূহের মধ্যে চারটি দিবস, মাসসমূহের মধ্যে চার মাস, নারীদের চারজন, সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশকারী চারজন এবং জান্নাত যেসব নেক বান্দার প্রত্যাশী তাদের মধ্যে চারজনকে নির্বাচন করে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। চারটি দিবস হলো—জুমাবার, আরাফাতের দিন, ঈদুল আজহার দিন ও ঈদুল ফিতরের দিন। চারটি মাস হলো—রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম। মহীয়সী চারজন নারী হলেন হজরত মরিয়ম বিনতে ইমরান (আ.), হজরত খাদেজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা), হজরত আছিয়া বিনতে মাজাহিম (আ.), হজরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (সা.)। সর্বাগ্রে যাঁরা জান্নাতে প্রবেশ করবেন, সেই সৌভাগ্যবান চারজন হলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.), পারস্যবাসীদের মধ্যে হজরত সালমান ফারসি, রোমিদের মধ্যে হজরত সোয়ায়ের রুমি (আ.), হাবশাবাসীদের মধ্যে হজরত বেলাল (রা.)। জান্নাত যাঁদের জন্য উদ্গ্রীব তারা হলেন হজরত আলী (রা), হজরত সালমান ফারসি (রা), হজরত আম্মার ইবন ইয়াসার (রা.) (মুকাশাফাতুল কুলুব)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, যে ব্যক্তি ৮ জিলহজ রোজা রাখবে আল্লাহ তাকে হজরত আইয়ুব (আ.)-এর মতো কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণের সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি আরাফাতের দিন রোজা রাখল, আল্লাহ তাআলা তাকে হজরত ঈসা (আ.)-এর মতো সওয়াব দান করবেন। মহানবী (সা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে, যখন আরাফাতের দিন আসে তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর রহমত ছড়িয়ে দেন। এই দিনে যে পরিমাণ লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, অন্য কোনো দিন তা দেওয়া হয় না। যে ব্যক্তি আরাফাতের দিনে রোজা রাখে, তার বিগত বছর ও আগামী বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (মুসলিম)
কোরবানিদাতার করণীয়: জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত কোরবানিদাতার চুল, গোঁফ, নখ, বগল ও অন্যান্য স্থানের লোম বা পশম না কাটা মুস্তাহাব। এ সম্পর্কে হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কোরবানির ইচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কোরবানি না করে ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৬৫৬)। এ আমল মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। ফিকাহবিদরা বলেছেন, কোরবানি করার আগে নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি না কাটার পেছনে হিকমত হচ্ছে হজযাত্রীদের সঙ্গে সাদৃশ্য করা। কারণ তাদের ইহরাম অবস্থায় এসব কাটা নিষিদ্ধ। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কিছু অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানি (ত্যাগ) করার ব্যাপারে যেন সে অভ্যস্ত হয়, এ জন্যই এ নির্দেশ।
তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা: জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখের আসর নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব। এটি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর সব বালেগ, পুরুষ, মহিলা, মুকিম, মুসাফির, গ্রামবাসী, শহরবাসী, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়কারী বা একাকী আদায়কারী প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। (ফাতাওয়ায়ে শামি ও বাহরুর রায়েক)। এই তাকবির একবারের বেশি না বলা বাঞ্ছনীয়। কারণ একের অধিক বলার বিধান নেই। (তাহতাবি, পৃষ্ঠা নম্বর ২৯৪) তাকবিরে তাশরিক হলো—আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহ আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
পশু কোরবানি করা: এই দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার রবের উদ্দেশে সালাত আদায় করো ও কোরবানি করো।’ (সুরা : কাউসার, আয়াত : ২)
ইবনে কাসির (রহ.) বলেছেন, সুরা ফজরের এক ও দুই আয়াতে তথা শপথ প্রভাতের, শপথ ১০ রাতের, যে ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে, তা জিলহজের প্রথম দশক। (ইবনে কাসির চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা নম্বর ৫৩৫)
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী