মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী: ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাতুল লিমান কানা ইয়ারজুল্লাহা ওয়াল ইয়াওমাল আখির।’ বর্তমান বিশ্বের অশান্তিময় পরিবেশকে শান্তিময় করার উপায় কী? এ জটিল প্রশ্নের সহজ এবং এক কথার উত্তর হলো আল কোরআনের এ আয়াত। আয়াতের অর্থ হলো, ‘যারা আল্লাহর থেকে ভালো ও কল্যাণময় জীবন আশা করে এবং পরকালের জীবনে বিশ্বাস করে, নিশ্চয় জেনে রাখো! তোমাদের জন্য রসুলের জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ সূরা আহজাব, আয়াত ২১।
‘আদর্শ’ একটি ব্যাপক শব্দ। এক কথায় আদর্শ বলতে আমরা বুঝি, অনুকরণীয়-অনুসরণীয় ব্যক্তি বা বস্তুকে আদর্শ কিংবা নমুনা বলে। মানুষের মধ্যে যারা বিশ্বাসী তাদের জন্য আদর্শ হলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটা কোরআনের ঘোষণা। তাঁর পুরো জীবনের প্রতিটি দিক অনুসরণ-অনুকরণের মাধ্যমেই দুনিয়ার কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি রয়েছে। আল্লাহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে বার বার বলছেন, ‘যে রসুলকে মেনে চলেছে, সে আল্লাহকেই মেনে চলল।’ আরেক আয়াতে আল্লাহ শর্ত দিয়েছেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও তাহলে নবীকে মেনে চল।’
বড় আফসোসের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমরা যারা বিশ্বাসী, নবীর উম্মত বলে নিজেদের দাবি করি; আমরা জীবনের প্রতিটি দিকে তাঁকে মেনে চলতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। একেকজন নবীর একেকদিক নিয়ে পড়ে রয়েছি। কেউ নবীর জুব্বা নিয়েছি, কেউ নিয়েছি দাড়ি। কেউ রুহহীন ওঠাবসার নামাজটুকুন, কেউ বা হজ আবার কেউ নিয়েছি সামাজিক জনকল্যাণমূলক কাজের সুন্নত। কিন্তু নবীকে পুরোপুরি অনুসরণ-অনকরণ আমরা কেউই করতে পারছি না। অর্থাৎ নবীকে আমাদের জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি।
সৈয়দ রশিদ আহমদ জৈনপুরী (রহ.) একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে তার ভক্তদের বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে এত অরাজকতা বিশেষ করে মুসলমানদের মাঝে এত দলাদলি-হানাহানি-কাটাকাটির একমাত্র কারণ অন্তরের গভীরে তারা নবীপ্রেম ও নবী আদর্শ লালন করতে পারেনি। তাদের হৃদয়ে যদি নবীপ্রেম থাকত, জীবনে যদি নবীর আদর্শ থাকত, তাহলে নবীর দাঁতভাঙা রক্তঝরা ইসলাম নিয়ে এভাবে তামাশা করতে পারত না।’ জৈনপুরের হজরত বলেন, ‘বাবারা! তোমরা নবীর সুন্নত মেনে দাড়ি রাখ, জুব্বা পর, পায়জামা টাখনুর ওপরে তুলে রাখো; কিন্তু মিথ্যা ছাড়তে পারো না, সুদ ছাড়তে পারো না, ঘুষ ছাড়তে পারো না, জেনা-ব্যভিচারের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলো, মাদকের সমুদ্রে ডুবে থাকো, জুয়ার সম্রাট বনে যাও; তাহলে বল তো তোমরা কি সত্যিকার অর্থেই জীবনে মুহাম্মদ নামক সোনার মানুষটিকে ধারণ করতে পেরেছ?’
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংকেত অনুসরণ-অনুকরণ করা মানে শুধু তিনি কী খেলেন, কী পরলেন, কীভাবে ঢিলা কুলুপ নিলেন; এগুলোই অনুসরণ-অনুকরণ নয়, তাঁকে অনুসরণের মানে হলো, তিনি কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনড় ছিলেন, মিথ্যার প্রতি কঠোর ছিলেন, হালালের প্রতি অটল ছিলেন, সত্যের প্রতি কোমল ছিলেন, মানুষের প্রতি নরম ছিলেন; এসবও অনুসরণ করা। কিন্তু আজকের দিনে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের এই দিকগুলো অনুসরণের, এই সুন্নতগুলো মেনে চলার মুসলমান হাতে গোনা এক-দুজন। বাকি সবাই লোক দেখানো সুন্নতি বেশধারী মুসলমান। তাদের জীবনে রসুলের গোটা জীবনের আদর্শ নেই।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জš§ মাসে আমরা যেন আরও বেশি মেকি নবীপ্রেমিক হয়ে ওঠি। আমরা বড় বড় মিছিল করে বোঝাতে চাই, আমাদের চেয়ে বড় নবীপ্রেমিক আর কেউ নেই। অথচ আমাদের প্রতিটি মুহূর্তই নবীর জীবনাদর্শকে জ'বাই করে ফেলছি। রবিউল আউয়াল মাসে নবীর আদর্শ জীবনে ধারণ করার প্রাণখোলা আহ্বান নিয়ে শেষ করছি আজকের লেখাটি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন, আমরা যেন তাঁর নবীর গোটা জীবনকে ভালোবাসতে পারি।
লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন।