মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি: মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে। এই কুরাইশ বংশ পূজা-পার্বণের জন্য তৎকালে ব্যবহৃত কাবাঘরের তত্ত্বাবধান করত, যা ছিল আরবদের কাছে গর্বের বিষয়। এই বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে ধনসম্পদ গড়ার অনেক সুযোগ ছিল মহানবী (সা.)-এর। তা ছাড়াও ইসলাম প্রচার বন্ধের বিনিময়ে অকল্পনীয় ধনসম্পদ, জমি-জিরাত ও ভোগবিলাসের অসংখ্য প্রস্তাব দিয়েছিল ইসলামের শত্রুরা। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) সব কিছু উপেক্ষা করে এমনকি নিজের এবং নিজ পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইসলাম প্রচারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সচেষ্ট ছিলেন। তদুপরি তাঁর যা কিছু সম্পদ ছিল, তার সবই তিনি প্রতিনিয়ত দান করে দিতেন। ফলে মৃত্যুর আগে তেমন কিছুই রেখে যাননি একান্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এবং অতি অল্পে সন্তুষ্ট বিশ্বের সর্বকালের সেরা মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তদুপরি যৎসামান্য যা-ই তিনি রেখে গিয়েছিলেন, তা নিয়ে শিরক বা বেদাত হতে পারে বিধায় তা গোপন করার বহু ঘটনা ঘটেছে। ওহাবি আন্দোলনের সময় এমন বহু ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। তাই পৃথিবীর বুকে নিতান্ত সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত মহানবীর (সা.) স্মৃতি স্মারকের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
সর্বাধিক সংগ্রহ তোপকাপি জাদুঘরে (তুরস্ক)
মুসলিম বিশ্বে তথা পৃথিবীর বুকে বিখ্যাত কয়েকটি জাদুঘরের মধ্যে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অবস্থিত তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘর অন্যতম। জাদুঘরে রূপান্তরের আগে তোপকাপি প্রাসাদের নির্মাণকাজ উসমানীয় শাসক দ্বিতীয় মেহমেদের আমলে ১৪৫৯ সালে শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আজও নান্দনিক এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ। পরে তা উসমানীয় সুলতান বা সম্রাটদের মূল বাসস্থান এবং প্রশাসনিক কাজকর্মের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। চারটি বৃহৎ প্রাসাদ, ছোট ছোট বেশ কিছু ইমারত রাজা-বাদশাহদের পারিবারিক বাসস্থান, নারীদের পৃথক অন্দরমহল, বিনোদনের হেরেমখানা, রাজকর্ম পরিচালনার জন্য অফিস-আদালত এবং আন্তর্জাতিক অতিথিদের আপ্যায়ন ও সম্মেলন কক্ষের সমন্বয়ে যুগের পর যুগ ধরে গড়ে তোলা হয় এই প্রাসাদ। ১৫০৯ সালে ভূমিকম্প এবং ১৬৬৫ সালে আগুনে প্রাসাদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সপ্তদশ শতকে সুলতানরা তোপকাপি প্রাসাদ ছেড়ে ধীরে ধীরে নতুন প্রাসাদ ভোলমা বাহেকে স্থানান্তরিত হন। ফলে জৌলুশ হারাতে থাকে তোপকাপি প্রাসাদ।
১৯২৩ সালে উসমানীয় শাসন শেষ হলে ১৯২৪ সালের ৩ এপ্রিল তারিখের সরকারি আদেশে তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে এই জাদুঘরে কয়েক শ কক্ষ ও চেম্বার রয়েছে। ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো তোপকাপি প্রাসাদকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।
তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরের আকর্ষণ পৃথিবীজুড়ে। নান্দনিক সৌন্দর্য, নির্মাণশৈলী, শিল্পগুণ, সংগ্রহের বৈচিত্র্য ইত্যাদি নানা কারণে লাখো মানুষ প্রতিবছর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ভিড় জমান এই তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘর দেখার জন্য। তবে দর্শকদের জন্য মূল আকর্ষণ তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে রাখা পবিত্র কোরআনের মূলকপি এবং প্রিভি চেম্বার নামে পরিচিত একটি বিশেষ কক্ষ, এ ছাড়াও জাদুঘরের এই অংশটিকে কেন্দ্রীয় পবিত্র ঘর বলা হয়।
এই কেন্দ্রীয় পবিত্র ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে মহানবী (সা.)-এর বেশ কিছু পবিত্র স্মৃতি স্মারক। এ ছাড়াও আরও কয়েকজন নবী, ইসলামের খলিফা, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকটাত্মীয়দের স্মৃতিস্মারকসহ অসংখ্য দু®প্রাপ্য সংগ্রহে সমৃদ্ধ তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘর। ওহাবি আন্দোলনের সময় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মহানবী (সা.) সহ অন্যান্য খলিফা ও মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়দের কবর ও রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস হতে থাকে। ওহাবি মতবাদে শিরক ও বেদাত থেকে বাঁচার জন্য এই অপসারণ প্রয়োজন ছিল।
অন্যদিকে আরেক দল মুসলমান এসব স্মৃতি স্মারক সংগ্রহের পক্ষে ছিলেন এবং বিভিন্নভাবে তৎকালীন তুরস্কের শাসকদের কাছে তা গচ্ছিত রাখেন। পরবর্তীতে এসব স্মৃতি স্মারকই তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরের মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়।
জুব্বা (লম্বা জামা)
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ব্যবহৃত পোশাকের মধ্যে মাত্র একটি দীর্ঘকায় তৎকালীন আরবীয় প্রথা অনুসারে তৈরি বিশেষ জামা বা জুব্বা তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে রয়েছে বলে দাবি করা হয়। গবেষকদের মতে, মহানবী (সা.)-এর সময়কার কবি কাব ইবনে জুহাইর ইসলাম গ্রহণের পর কবিতার মাধ্যমে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রশংসা করতেন এবং বিধর্মীদের বিরূপ কবিতার প্রতিউত্তর দিতেন।
তৎকালীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে মহানবী (সা.) কবি কাব ইবনে জুহাইরকে তাঁর একটি জুব্বা (জামা) উপহার দেন। পরবর্তীতে এই কবির সন্তানরা উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতার কাছে এই পবিত্র জুব্বা (জামা) বিক্রি করে দেন। এই জুব্বা লম্বায় প্রায় দুই গজ এবং ফুলহাতাযুক্ত। কালের বিবর্তনে জুব্বার রং পরিবর্তিত হতে পারে ধারণা করা হলেও গবেষকদের মতে জুব্বার রং ছিল হালকা ঘিয়া বা ক্রিম কালারের। বর্তমানে তোপকাপি জাদুঘরে একটি স্বর্ণখচিত স্বচ্ছ বাক্সে এই পবিত্র জুব্বা রাখা আছে। প্রতি বছর রমজান মাসের ১৫ তারিখে এই জুব্বা জনসাধারণকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। অন্য সময়ে এই জুব্বা দেখার সুযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
যুদ্ধের ব্যানার
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জমানায় যুদ্ধক্ষেত্রে পতাকার পাশাপাশি চারকোনা কাপড়ের তৈরি বিশেষ ধরনের ব্যানার বহনের প্রচলন ছিল। মহানবী (সা.)-এর ব্যবহৃত এমনি একটি ব্যানার রয়েছে তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে। অনেকের মতে, মহানবী (সা.)-এর আমল থেকে এই পবিত্র ব্যানারটি বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন হাত ঘুরে বর্তমান জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। আবার আরেক দল গবেষকের বর্ণনা মতে, ব্যানারের মূল কাপড়টি মূলত মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী মা আয়েশা (রা.)-এর ঘরের দরজায় পর্দা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে চারপাশে পাড় বা আরও কাপড় বর্ডার হিসেবে সংযুক্ত করে ব্যানারের আকার বৃদ্ধি করা হয়। বিভিন্ন যুদ্ধে এই ব্যানার দেখামাত্র মুসলমান সৈন্যরা আল্লাহু আকবর অর্থাৎ আল্লাহ মহান ধ্বনিতে চারদিক প্রকম্পিত করত এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এই ব্যানার মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখত। উসমানীয় শামনামলে খলিফা সেলিম (প্রথম) এই ব্যানার সংগ্রহ করেন এবং দামেস্কের একটি মসজিদে নিয়ে যান বলে জানা যায়। পবিত্র হজে গমনকারী কাফেলায় এই পবিত্র ব্যানার দেখা যেত। উসমানীয় খলিফা মুরাদ (তৃতীয়) ১৫৭৪ সালে হাঙ্গেরিতে পাঠানো সেনাদের হাতে এই ব্যানার তুলে দেন। পরবর্তীতে খলিফা মুহাম্মদ (তৃতীয়) এই ব্যানার তুরস্কে ফেরত আনেন বলে জানা যায়। কালের পরিক্রমায় তা ঠাঁই করে নেয় এই জাদুঘরে।
দাফতরিক সিলমোহর
পৃথিবীতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিচয় কেবল একজন ধর্ম প্রচারকের গ-ির মধ্যে আবদ্ধ রাখার সুযোগ নেই। একাধারে একজন সফল রাষ্ট্রীয় বা বিশ্বমাপের নেতা, সমাজ সংস্কারক, সংগঠক, সেনাপতি, শান্তির দূত ইত্যাদি নানাবিধ পরিচয়ে তিনি বারবার আবির্ভূত হয়েছেন বাল্যকাল থেকেই। বৃহৎ পরিসরের এসব কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করার জন্য তাকে বহু চিঠি পাঠাতে হয়েছিল।
তবে এক পর্যায়ে দেখা যায়, তাঁর শত্রুরা বিভ্রান্তি ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম ব্যবহার করে হীনস্বার্থে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠাতে থাকে। শত্রুদের এই অশুভ তৎপরতা বন্ধের জন্য মহানবী (সা.) একটি সিল তৈরি করেন এবং চিঠি লেখার পর এই সিলের ছাপ দেওয়ার প্রথা চালু করেন। দেশ-বিদেশে তিনি প্রচার করেন যে, তাঁর সিল মুদ্রিত না থাকলে সেই চিঠি তাঁর নয় বলে গণ্য করতে হবে। এই সিলটিকে তিনি একটি আংটির আকার প্রদান করেন এবং সর্বদা তাঁর কাছে রাখতেন। বর্তমানে তোপকাপি জাদুঘরে একটি ডিভানের ওপর রাখা একটি ছোট বাক্সে এই সিল সংরক্ষিত আছে বলে দাবি করা হয়। বিশেষ ধরনের পাথর খোদাই করে এই সিল তৈরি করা হয়েছিল। সিলটি বর্তমানে ক্রিস্টালে আবদ্ধ যার মাপ দৈর্ঘ্যে ৪ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৩ ইঞ্চি। সিলটি ছিল গোলাকার, যার মধ্যে তিন লাইনের উপরে আল্লাহ, মধ্যখানে রসুল এবং নিচে মুহাম্মদ (সা.) লেখা ছিল।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওফাতের পর ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এবং দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর হাত ঘুরে সিলটি ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা)-এর হস্তগত হয়। একদল গবেষকের মতে, হজরত ওসমান (রা)-এর আমলে অসাবধানতাবশত একটি পানির কূপে আদি বা প্রকৃত সিলটি পড়ে যায়। কূপের গভীরতা বেশি হওয়ায় সিলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য সম্পূর্ণ বিষয়টি গোপন করে অনুরূপ আরেকটি সিল তৈরি করা হয়, যা বর্তমানে তোপকাপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
যুদ্ধে ব্যবহৃত তরবারি
পবিত্র কোরআন শরিফের ২১তম সূরা আম্বিয়ার ১০৭নং আয়াতে মহান আল্লাহ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে পৃথিবীর জন্য বিশেষ আশীর্বাদ বা রহমত হিসেবে প্রেরণের ঘোষণা প্রদান করেন। তাই মহানবী (সা.)-কে বলা হয় রহমাতাল্লিল আলামিন বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের আশীর্বাদ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়। ক্ষমা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম আদর্শ ও সৌন্দর্য, তথাপি তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন কেবল নিজ ও সঙ্গীদের জীবন রক্ষা এবং পৃথিবীতে ইসলাম, কোরআন ও সুন্নাহকে টিকিয়ে রাখতে। তৎকালীন আরব ঐতিহ্য অনুসারে যে কোনো পরিবারের পুরুষ সদস্যরা জন্মগত বা বংশগতভাবে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তরবারি লাভ করতেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগতভাবে বা উত্তরাধিকার সূত্রে দুটি তরবারি লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়। শত্রুকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করে শত্রুর সম্পদ ও সমরাস্ত্র নিজেদের কাজে লাগানোর প্রথা বিরাজমান ছিল মহানবী (সা.)-এর জমানায়। ইতিহাস মতে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত তিনটি তরবারি ছিল মহানবী (সা.)-এর জিম্মায়। আরও কিছু তরবারি তিনি উপহার বা উপঢৌকন হিসেবে পেয়েছিলেন। সর্বসাকুল্যে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে ৯টি (মতান্তরে ১১টি) তরবারি ছিল বলে দাবি করা হয়। এর মধ্যে ৮টি তরবারি তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে এবং একটি তরবারি মিসরের কায়রোতে সংরক্ষিত রয়েছে। মহানবী (সা.)-এর বেশিরভাগ তরবারির আলাদা আলাদা নাম ছিল। যেমন ‘আল মাথুর’ নামের ৯৯ সেমি লম্বা তরবারিটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন, যার বুকে খোদিত আবদুল্লাহ ইবনে মুত্তালিব অর্থাৎ মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহ। উল্লেখ্য, মুত্তালিব মহানবী (সা.)-এর দাদা এবং আবদুল্লাহ তার বাবার নাম। এই তরবারি হিজরতের সময় মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিল এবং জীবনের একপর্যায়ে মহানবী (সা.) তরবারিটি হজরত আলী (রা.)-এর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৪০ সে.মি. লম্বা আর একটি তরবারি রয়েছে তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে, যা পারিবারিকভাবে লাভ করেছিলেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আর রুসাব নামের এই তরবারিতে স্বর্ণের চুরির মতো চাকতি সংযুক্ত রয়েছে। নবী-রসুলদের তরবারি হিসেবে পরিচিত ১০১ সেমি লম্বা আল বাট্টার নামের তরবারি। এই তরবারিতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছাড়াও হজরত দাউদ (আ.), সুলাইমান (আ.), মুসা (আ.), জাকারিয়া (আ.), ঈসা (আ.)-এর নাম খোদাই করা হয়েছে। এমন ধরনের মোট ৮টি তরবারি সংরক্ষিত আছে তোপকাপি জাদুঘরে।
বিশেষ ধরনের বাটি
রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত একটি শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ, যার অধিকাংশ হানাফি এবং শাফী মাজহাব অনুসরণকারী মুসলমান। তবে দেশটির প্রকৃত জনসংখ্যা দুটি বড় যুদ্ধের পর এত বেশি না হওয়ার দিকে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। দুটি বড় যুদ্ধ এবং থেমে থেমে খ-যুদ্ধের বাইরে ২০১১ সালে চেচনিয়া সব মুসলমান এবং ইতিহাসবিদের নজর কাড়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যবহৃত একটি বাটিকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন সূত্র মতে, চেচনিয়ার বিশিষ্ট এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রমজান কাদিরভ একজন ভিন্ন ধরনের মুসলমান নেতা হিসেবে সুপরিচিত। বিভিন্ন ব্যবসার পাশাপাশি বন্যপ্রাণী এবং বিলাসবহুল গাড়ি সংগ্রহের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে রমজান কাদিরভের।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে এক ভিডিওতে উজ্জ্বল রঙের লম্বা কোট এবং কালো টুপি পরিহিত অবস্থায় একটি ঐতিহাসিক বাটিসহ দেখা যায়। পরবর্তীতে তার বর্ণনা মতে জানা যায়, এই বাটিটি প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে এই বাটি মহানবী (সা.)-এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর কাছে রক্ষিত ছিল। কালক্রমে এই বাটি লন্ডনে চলে যায়। বাটি সংগ্রহে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করেন রমজান কাদিরভ। এরপর একটি বিশেষ জেট বিমানে বাটিটি লন্ডন থেকে চেচনিয়ার রাজধানী গজনিতে আনা হয়।
বিমানবন্দরে লন্ডন থেকে বাটি বহনকারী ব্রিটিশ মুসলমানদের কাছ থেকে এই বাটিটি গ্রহণ করে রমজান ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করেন। এরপর হাজার হাজার চেচনিয়ান মুসলমানের ভিড় ঠেলে একটি দামি রোলস রয়েসে চড়ে রমজান বাটিটি নিয়ে গজনির কেন্দ্রীয় মসজিদে হাজির হন। এই গাড়িটিকে ঘিরে ছিল কয়েক ডজন বিভিন্ন আকৃতির কার। বর্তমানে বাটিটি রমজান কাদিরভের কাছে আছে। তার ঘোষণা মতে, বাটিটি প্রতি বছর মহানবী (সা.)-এর জন্মদিনে সবার দেখার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং কেউ আগ্রহী হয়ে এই বাটিতে পানি পান করেন।
অন্যান্য স্মৃতি স্মারক
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যান্য স্মৃতি স্মারকের মধ্যে অন্যতম তার পবিত্র চুল এবং দাড়ি। বিদায় হজের পর মহানবী (সা.) মাথা মু-ন করেন। তখন তাঁর পবিত্র চুল সংগ্রহ করা হয় বলে তথ্য পাওয়া যায়। বর্তমানে ভারতের শ্রীনগর, দুবাই জাদুঘর, মস্কোর কেথেড্রাল মসজিদসহ আরও কিছু স্থানে এই পবিত্র চুল সংরক্ষিত আছে বলে দাবি করা হয়। তাছাড়াও তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে রয়েছে মহানবীর (সা.)-এর একটি পবিত্র দাড়ি। এর বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মহানবী (সা.)-এর ব্যবহৃত তীর-ধনুক, স্যান্ডেল, উহুদের যুদ্ধে শাহাদতকৃত দাঁত সংরক্ষিত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন জাদুঘর ও রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালায় রয়েছে মহানবী (সা.)-এর লেখা বেশ কিছু চিঠি। মূলত ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত জানিয়ে মিসর, সালতানাত অব ওমান, ইথিওপিয়া, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের এই চিঠি লেখা হয়। এসব চিঠিতে মহানবী (সা.) তার নামখচিত সিল ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশে কদম রসুল মসজিদ
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো একটি শক্ত স্থান বিশেষত পাথরের ওপর দাঁড়ালে পাথর নরম হয়ে দেবে যেত এবং পাথরে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র পায়ের ছাপ বা চিহ্ন পড়ে যেত বলে একাধিক তথ্য রয়েছে। তোপকাপি জাদুঘর, জেরুজালেম, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, মিসরের রাজধানী কায়রোসহ বহু দেশে এ ধরনের পদচিহ্ন বা ছাপযুক্ত পাথর দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরে এবং নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে নবীগঞ্জে কদম রসুল নামে পরিচিত দুটি মসজিদেই রসুলুল্লাহ (সা.)-এর পদচিহ্নযুক্ত পাথর রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সাবধানতা
মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি স্মারক সংগ্রহ বা দেখার কোনো বিধিবিধান কোরআন বা হাদিসে নেই। তাছাড়া এই স্মৃতি স্মারকের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করাও সমর্থন করেন না আলেম-ওলামাগণ। তবে জ্ঞান অর্জনের জন্য যে কোনো জাদুঘরে দেখা বা কোনো স্মৃতি স্মারক দেখা দোষের কিছু নয়। এসব স্মৃতি স্মারকের ঐতিহাসিক মূল্য সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তাই কেবল মুসলমান নয়, অমুসলমানরাও ভিড় করেন মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি স্মারক প্রত্যক্ষ করার জন্য।