ইসলাম ডেস্ক: মানবহৃদয়ের সবচেয়ে জ'ঘন্য রোগ হতাশা, যা অনুভূতিকে মে'রে ফেলে। নিরাশা, যা দুনিয়াকে অ'ন্ধকার করে দেয়। আশা চু'রমা'র এবং প্রত্যাশা মিটিয়ে দেয়। পথ রু'দ্ধ এবং উপকার ব'ন্ধ করে দেয়। আল্লাহর কিতাবে নিরাশা ও হতাশা সম্পর্কে দুটি আয়াত বিবৃত হয়েছে নি'ন্দনীয় হিসেবে। এ দুইয়ের পথ থেকে দূরে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ হতাশা অন্যতম কবিরা গোনাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না।’ (সূরা ইউসুফ : ৮৭)। তিনি আরও বলেন, ‘পালনকর্তার রহমত থেকে পথভ্রষ্টরা ছাড়া কে নিরাশ হয়?’ (সূরা হিজর : ৫৬)।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এখানে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, হতাশা ও নিরাশ হওয়া মোমিনের জন্য শোভন নয়। বরং মোমিন সর্বদা থাকে ভ'য় ও আশার মাঝামাঝি। সে ভ'য় করে নিজের পাপের অ'পরা'ধ ও অবা'ধ্যতার পরিণতিকে আবার সঙ্গে সঙ্গে নিজ আনুগত্য ও আমলের সুবাদে রবের দয়া, ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশা রাখে।
আল্লাহ তায়ালা নিজ বান্দাদের আশান্বিত করেছেন তাঁর দয়ায়। উদ্বুদ্ধ করেছেন তাঁর ক্ষমা পেতে। ঝু'লিয়ে দিয়েছেন তাঁর মাগফিরাতের প্রত্যাশা। তিনি এরশাদ করেছেন ‘বলুন, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর জু'লু'ম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা যুমার : ৫৩)। তিনি আরও এরশাদ করেন ‘আর আমার দয়া তা তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে। কাজেই আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, জাকাত দেয় এবং আমার আয়াতগুলোতে ঈমান আনে।’ (সূরা আরাফ : ১৫৬)।
মুসনাহ আহমাদে বিশুদ্ধ সূত্রে আবু জর গিফারি (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা বলেন, ‘হে আদম সন্তান, তুমি যতদিন আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে আশা করতে থাকবে, তোমার দ্বারা যা কিছু গোনাহ হয়েছে আমি তা ক্ষমা করে দেব। আর এ ব্যাপারে আমি কোনো পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান, তোমার গোনাহ যদি আকাশের মেঘমালায়ও উপনীত হয়, এরপর তুমি যদি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তবুও আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব; এতে আমার কোনো পরোয়া নেই। হে আদম সন্তান, তুমি যদি জমিন পরিমাণ গোনাহ নিয়েও আমার কাছে এসে উপস্থিত হও, আর আমার সঙ্গে যদি কিছু শরিক না করে থাক, তবে আমিও সে পরিমাণ মাগফিরাত (ক্ষমা) নিয়ে তোমার কাছে আসব।’
একইভাবে আবু আবদুল্লাহ বোখারি ও মুসলিম বিন হাজ্জাজ (রহ.) উভয়ের সহিহ গ্রন্থে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হয়েছে : নবী (সা.) বলেন হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি আমার প্রতি আমার বান্দার ধারণার কাছাকাছি থাকি।’ ইমাম আহমাদ, ইবনে হিব্বান ও হাকেমের কোনো কোনো বর্ণনায় আরও যুক্ত হয়ে এসেছে ‘অতএব আমার প্রতি যতটা চায় সে যেন আশা রাখে।’ তেমনি ইমাম মুসলিম (রহ.) এর সহিহ গ্রন্থে জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুর তিন দিন আগে এরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা ছাড়া মৃ'ত্যু'বর'ণ না করে।’ (মুসলিম)।
আল্লাহর বান্দারা, উল্লেখিত সব উদ্ধৃতি এবং এ মর্মে আরও যা বর্ণিত হয়েছে কোরআন ও সুন্নাহে তা ব্যক্তির সামনে খুলে দেয় আশা ও প্রত্যাশার বহু দ্বার। তাকে দূরে সরিয়ে দেয় হতাশা ও নিরাশা থেকে। তাকে দেখায় শ্রেয়তর দৃষ্টিভঙ্গি। নিয়ে যায় মহত্ত্বর পথে। তাকে এমন বানায় যে, সে অনাগত দিনগুলোতে সুধারণার দৃষ্টি দেয়, যাতে থাকে আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা এবং তাঁর কাছে সুন্দর পরিণতি।
আর আল্লাহর রাসুল (সা.) এর বাণী ‘তোমাদের কেউ যেন আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখা ছাড়া মৃ'ত্যুব'রণ না করে।’ আবুল আব্বাস কুরতুবি প্রমুখ বিজ্ঞ আলেমের মতে এর ব্যাখ্যা হলো : ‘সুধারণা ও সুপ্রত্যাশার পাশাপাশি নেক আমল ও উত্তম আচরণ অব্যাহত রাখো, যা আল্লাহর রহমতের আশা বাস্তবায়ন করবে। কেননা আল্লাহর রহমত নেককারদের নিকটবর্তী। তাঁর শাস্তির ভ'য় তো অবা'ধ্য ও অ'পরা'ধীদের জন্য। আর আমল ছাড়া শুধু সুপ্রত্যাশা তো দুরাশা। এটা স্বাভাবিক অবস্থার কথা। পক্ষান্তরে মৃ'ত্যু ঘনিয়ে আসা সময়ে তো একমাত্র আল্লাহর রহমতের আশা ছাড়া কোনো অবলম্বন নেই। যেমনটি বোঝা গেল উপরের আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে। তখন শুধু আল্লাহর প্রতি সুধারণাই তাকে অন্তর্ভুক্ত করবে তাঁর প্রিয় ও পছন্দের বান্দাদের কাতারে। যার সাক্ষ্য মেলে নবী (সা.) এর হাদিস থেকে। তিনি বলেন ‘প্রত্যেক বান্দাকে সেভাবেই তোলা হবে যার ওপর সে মৃ'ত্যুব'রণ করেছে।’ (জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) এর হাদিসটি ইমাম মুসলিম তার সহিহ গ্রন্থে সংকলন করেছেন)।
বলেন, আল্লাহ যখন কোনো বান্দার ভালো চান, তখন তাকে দুনিয়ায় কিছু ক'ষ্ট দিয়ে দেন (যাতে পরকালে সে এসব ক'ষ্ট থেকে মুক্ত থাকে)।
আল্লাহর বান্দারা, মালিকের প্রতি গোলামের সুধারণা কোনো নির্দিষ্ট অবস্থা, নির্ধারিত ঘটনা কিংবা ক্ষণিকের কোনো সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং যেমন সুধারণা রাখতে হবে আল্লাহর প্রতি ধাবিত হওয়া, তাঁর ক্ষমা ও মাগফিরাত লাভের ক্ষেত্রে, অনুরূপ তাঁর প্রতি সুধারণা রাখতে হবে এ দুনিয়ায় সব ধরনের বিপদ ও সংকটে। তাই যখন কোনো রোগ আ'ক্রম'ণ করে, ঋণের বোঝা আঁকড়ে ধরে বা প্রিয় কিছুর বিয়োগ ঘটে; তখনও তার কর্তব্য হবে, হতাশ না হওয়া এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে পড়া। বরং দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে, বিপদ যা এসেছে, নিশ্চয় তাতে কোনো মঙ্গল নিহিত রয়েছে। আল্লাহ এর দ্বারা মর্যাদা বাড়াবেন কিংবা গোনাহ মাফ করবেন অথবা এর চেয়ে বড় কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করবেন কিংবা যা হা'রিয়েছে তার উত্তম বিকল্প কিছু দেবেন। সেটা দ্রুত হোক বা দেরিতে। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে ইমাম বোখারি সংকলিত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে। রাসুল (সা.) তাতে বলেছেন, ‘আল্লাহর যার মঙ্গল চান, তাকে বিপদ দেন।’ অর্থাৎ তাকে বিভিন্ন বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। যেটি বর্ণিত হয়েছে তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ সংকলিত তাদের সুনান গ্রন্থে উত্তম সনদে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন ‘নিশ্চয় বড় প্রতিদান বড় বিপদের সঙ্গে। আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তাদের পরীক্ষা করেন। এ পরীক্ষায় যে খুশি থাকে তার জন্য আল্লাহও খুশি হয়ে যান, আর যে রা'গান্বি'ত হয়, তার জন্য তিনিও রে'গে যান।’ (তিরমিজি)।
সর্বোপরি আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে, আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণা মোমিনের চরিত্র নয়। আল্লাহর বিনীত বান্দার চরিত্র নয়। আল্লাহ তায়ালা কত ভয়কে নিরাপত্তায়, কত দারিদ্র্যকে প্রাচুর্যে পরিবির্তত করেছেন। বরং আল্লাহর প্রতি সুধারণা বহাল রাখতে হবে। তাঁর কাছে উত্তম বিনিময়ের প্রত্যাশা করে যেতে হবে। পাশাপাশি এও মনে রাখতে হবে, আমাদের ওপর যেসব বিপদ বা সংক'ট আসে তা আমাদেরই কর্মের প্রতিফল। যদিও আল্লাহ তায়ালা অনেক পাপই মাফ করে দেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন ‘আমি মানুষকে নেয়ামত দান করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অহংকারে দূরে সরে যায়; যখন তাকে কোনো অনি'ষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে। বলুন প্রত্যেকেই নিজ রীতি অনুযায়ী কাজ করে। অতঃপর আপনার পালনকর্তা বিশেষরূপে জানেন, কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পথে আছে।’ (সূরা ইসরা : ৮৩-৮৪)।
শায়খ ড. উসামা বিন আবদুল্লাহ খাইয়াত
২ রবিউস সানি ১৪৪১ হিজরি মক্কার
মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব