মুফতি সাইফুল ইসলাম: আল্লামা ইবনে কায়্যিম জাওযিয়্যাহ (রহ.) লেখেন—মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত এই নামাজ আদায় করার পন্থা, একাগ্রতা ও ঐকান্তিকতার বিচার-বিশ্লেষণে মুসলিম সমাজে পাঁচ প্রকারের নামাজির দেখা মেলে। নামাজ পড়তে গিয়ে মুসল্লিরা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়।
নামাজ মুসলিম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একজন মুসলিম কিছুতেই নামাজকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ঈমান আনার পর ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয়টিই হচ্ছে নামাজ। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনদের ওপর ফরজ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০৩) ইসলামের পরিভাষায় ফরজ মানেই হচ্ছে অবশ্যকরণীয়। যা না করে কোনো উপায় নেই। নামাজ এমন একটি ইবাদত, যেখানে বান্দা ও তার প্রভুর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে অন্তত ৮২ স্থানে নামাজের কথা বলা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর জীবনের শেষ আদেশও ছিল এই নামাজ।
সপ্তশতকের আধ্যাত্মিক রাহবার ও জগদ্বিখ্যাত লেখক, ইমাম ইবনে কায়্যিম জাওযিয়্যাহ (রহ.) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কিতাব আল-ওয়াবিলুস সায়্যিবের সালাতের একাগ্রতা অধ্যায়ে লেখেন—মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত এই নামাজ আদায় করার পন্থা, একাগ্রতা ও ঐকান্তিকতার বিচার-বিশ্লেষণে মুসলিম সমাজে পাঁচ প্রকারের নামাজির দেখা মেলে। নামাজ পড়তে গিয়ে মুসল্লিরা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে যায়।
প্রথম প্রকার মুসল্লি হলো মুহাকাব : এ প্রকারের মুসল্লিরা নিজের নফসের ওপর জুলুম ও সীমালঙ্ঘনকারী। অর্থাৎ সালাতের অজু, সময়, সুন্নত ও রুকন সব ক্ষেত্রেই ত্রুটিকারী মুসল্লি। এরা নামাজের প্রতি কোনো ধরনের গুরুত্বারোপ করে না। কখনো নামাজ পড়ে তো কখনো পড়ে না। এরা নামাজের দ্বারা সওয়াব পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আরো শাস্তি পাবে। কেউ বলতে পারে যে নামাজ আদায় করেও যেহেতু শাস্তিপ্রাপ্ত হতে হবে, তাহলে নামাজ আদায় না করাই তো ভালো? না ভাই! একটি কথা মনে রাখতে হবে। মনে করুন, দুজন ব্যক্তি কোনো দায়িত্বশীলের কাছ থেকে একটি কাজ করার আদেশপ্রাপ্ত হলেন, তারপর একজন ত্রুটিযুক্তভাবে কাজটি সম্পাদন করলেন আরেকজন কাজটি করলেনই না। এ ক্ষেত্রে দুজনই তিরস্কারের শিকার হবেন কিন্তু দুজনের তিরস্কার আর শাস্তি কি এক হবে?
দ্বিতীয় প্রকার মুসল্লি হলো মুহাসাব : এ প্রকারের মুসল্লিরা সালাতের সময়, সুন্নত, বাহ্যিক রুকন ও অজুর হক আদায় করেন বটে; কিন্তু নফসকে আয়ত্তে এনে তার ওয়াসওয়াসা দূর করতে অবহেলা করে। এরূপ মুসল্লি নফসের দাস, চিন্তা ও ওয়াসওয়াসার গোলাম। নামাজের মধ্যে এদের কোনো মনোযোগ থাকে না। মনোযোগ আনার চেষ্টাও করে না। শুধু নামাজ শুরু করে আর শেষ করে। নামাজের মাঝখানে কী পড়েছে আর কী করেছে তার কিছুই সে জানে না। এরা নামাজের প্রতি উদাসীনতার জন্য জবাবদিহির শিকার হবে। অপ্রিয় সত্য কথা হলো, আমাদের মুসলিম সমাজে এই শ্রেণির মুসল্লিই সবচেয়ে বেশি।
তৃতীয় প্রকার মুসল্লি হলো মুফাফফার আনহু : এ প্রকারের মুসল্লিরা সব সুন্নত ও রুকন ঠিকঠাক আদায় করে, অন্তরের ওয়াসওয়াসা ও নফসের কুমন্ত্রণা দূর করতেও চেষ্টা করে। এ শ্রেণির মুসল্লিরা সব রুকন ও শর্ত আদায়ের পাশাপাশি মনোযোগ ধরে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু শতভাগ মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হতে পারে না। এরা হলো সেই শ্রেণির মুসল্লি, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা নামাজের উসিলায় তাদের গোনাহখাতা মাফ করে দেন। এরা নামাজের মাধ্যমে দায়মুক্ত হবে।
চতুর্থ প্রকার মুসল্লি হলো মুসাব : এ প্রকারের মুসল্লিরা নামাজের সব হক, রুকন ও সুন্নত আদায় করে, অন্তরকেও তার সুরক্ষা ও হক আদায়ে লিপ্ত রাখে, যেন সামান্য সওয়াবও নষ্ট না হয়, যথাযথভাবে সালাত আদায়েও পূর্ণ করতে চেষ্টার সেরাটা ব্যয় করে। এরূপ মুসল্লি নামাজের পুরো সময়টাতে খুশু ও রবের ইবাদতে মগ্ন থাকে। তার নামাজ আদায় করা আল্লাহ দেখছেন এটি বারবার মনে জাগ্রত করে। এরা নামাজের বিনিময়ে যথোপযুক্ত সওয়াব পাবে।
পঞ্চম প্রকার মুসল্লি হলো মুকাররাব : এ প্রকারের মুসল্লিরা চতুর্থ প্রকারের মুসল্লির ন্যায় সালাতের সব রুকন ঠিকঠাক আদায় করে, অধিকন্তু সে নিজের অন্তরকে ধরে এনে রবের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে, অন্তর দিয়ে রবকে দেখে ও দেখার চেষ্টা করে। তার অন্তর রবের মহব্বত ও বড়ত্বে পরিপূর্ণ, তার অবস্থা এমন হয়; যেন সে রবকে দেখছে ও প্রত্যক্ষ করছে, ফলে তার কুমন্ত্রণা ও চিন্তাগুলো দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং তার ও তার রবের মধ্যকার বাধাগুলো সরে যায়। এই শ্রেণির মুসল্লির নামাজের সঙ্গে অন্য শ্রেণির মুসল্লির নামাজে আসমান ও জমিনের পার্থক্য। কেননা সে নামাজের পুরো সময়টিতে রবকে নিয়ে ব্যস্ত এবং তাঁকে নিয়েই পরিতৃপ্ত ছিল। এরা হলো আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত মুসল্লি। যারা নামাজকে নিজের চোখের শীতলতা বানিয়েছে। বলাই বাহুল্য দুনিয়ায় যার চোখ নামাজের দ্বারা শীতল হবে আখিরাতে তার চোখ রবের নৈকট্য পেয়ে শীতল হবে।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান বিচার করে নামাজের ক্ষেত্রে আরো বেশি মনোযোগী ও যত্নশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।