মো.আবু রায়হান: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সং'ক্রমিত হওয়ায় বিভিন্ন মুসলিম দেশে আজান নিয়মিত হলেও মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।এদিকে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মরক্কো, থাইল্যান্ড ও আরব আমিরাতসহ অনেক মুসলিম দেশে জুমার নামাজের খুতবা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
আবার কোথাও জুমার নামাজও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রকো'প হ্রা'স পেলে তা আবার পুনর্বহাল হবে। বাংলাদেশেও ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে জনসমাগম এ'ড়িয়ে মসজিদে উপস্থিতি সীমিত করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।ইসলাম জামাতে নামায পড়ার বিশেষ গুরুত্ব ও তাকিদ দিয়েছে। জামাতে নামাজ আহনাফের কাছে সুন্নাত মুয়াক্কাদা হলেও আমলগতভাবে ওয়াজিব। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'তোমরা নামায সুপ্রতিষ্ঠিত কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।'(সূরা বাকারা, আয়াত-৪৩)।মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ে অপরিসীম সওয়াবের কথা বলা হয়েছে।মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের সওয়াব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জামাতে নামাজ পড়ার ফজিলত একা পড়ার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি।’ (সহিহ বোখারি ও মুসলিম) এমনকি বিনা ওজর আপত্তিতে মসজিদে নামাজ আদায় না করলে তার জন্য ইসলাম কঠোর হু'শিয়ারী দিয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)'র দরবারে এসে নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি অন্ধ এবং আমার ঘর মসজিদ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। আমি কি জামাতে অংশগ্রহণ না করে আমার ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি পেতে পারি? রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘তুমি কি নামাজের দেয়া আজানের শব্দ শুনতে পাও?
আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম বললেন, ‘জি হ্যাঁ’ শুনতে পাই।তখন প্রিয়নবি (সা.) বললেন, তবে তুমি সেই (আজানের) ডাকে সাড়া দাও। আজানের শব্দ শুনলে উহার ডাকে তোমার মতো অন্ধকেও তাতে সাড়া দিয়ে মসজিদে নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ করতে হবে। রাসুল (সা.)বলেন , ‘আমি তোমার জন্য অব্যহ'তির কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মসজিদ আল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীতে ২০ মার্চ থেকে জুমা নামাজ স্থগিত করেছে সৌদি সরকার। শুধু সৌদি আরব নয় বাহরাইনসহ একাধিক আরব দেশ জুমার নামাজ স্থগিত করেছে।পাকিস্তানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া অনুযায়ী জুমা বন্ধ রেখেছে।বর্তমান পরিস্থিতিতে আজানের বাক্যও পরিবর্তন হয়েছে। আজানে ‘হাইয়া আলাসসালাহ’ এর পরিবর্তে ‘সাল্লু ফির রিহাল বা সাল্লু ফী বুয়ুতিকুম’ বলে আহবান করা হয়েছে ।জরুরি পরিস্থিতিতে এমনটি করার বিধান রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের যুগে ছিল বলে ওলামায়ে কেরামদের অভিমত।
করোনা পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সামাজিক দূরত্বের কথা বলছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই জরুরি, কারণ আক্রা'ন্ত কেউ হাঁচি কাশি দিলে তার সূক্ষ্ম থুতুকণা যাকে ইংরেজিতে ‘ড্র'পলেট’ বলা হয় তা বাইরে বাতাসে ছ'ড়িয়ে পড়ে। এই ড্র'পলেটের মধ্যে ঠাসা থাকে ভাইরাস।যেসব জায়গায় এ কণাগুলো পড়ে সেসব জায়গায় যদি আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করেন, এবং তারপর আপনার সেই অপরিষ্কার হাত আপনি মুখে দেন অথবা খুব কাছ থেকে সেই কণাগুলো নি:শ্বাসের মধ্যে দিয়ে আপনার শরীরে ঢো'কে, আপনি সং'ক্রমিত হবেন।সামাজিক দূরত্বের সীমা হতে পারে কমপক্ষে তিনহাত। মসজিদে গিয়ে আপাতত সামাজিক দূরত্ব র'ক্ষিত হচ্ছে না।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, মসজিদে প্রবেশের পর থেকে নামাজ পড়া পর্যন্ত ১৯টি স্থানে মসজিদে আগত একজন মুসল্লির স্প'র্শ লাগে। ওই সমস্ত স্থান অন্যরাও ব্যবহার করেন। মুসল্লিদের দুটি অবস্থা থাকে। হয় অন্যের সং'স্পর্শ থেকে আক্রা'ন্ত হতে পারে অথবা সে না জেনেই অন্যকেও সং'ক্রমিত করতে পারে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সং'স্পর্শের দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি।
বিশেষ পরিস্থিতিতে মসজিদ বা জনসমাগম থেকে দূরে অবস্থান করে নামাজ আদায়ের কোনো সম্ভাবনার কথা কি ইসলাম বলে?কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জীবনের নিরাপ'ত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ধ্বং'সাত্ম'ক জায়গায় নিজেকে ফেলে জীবনের শ'ঙ্কা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন।ধ্বং'সা'ত্মক জায়গা বলতে এখানে মহাম'রি, বি'পদের স্থান বলতে চেয়েছি। আল্লাহ পাক বলেন, ‘আর নিজের জীবন ধ্বং'সের সম্মু'খীন করো না। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন। (সুরা বাকারা, আয়াত - ১৯৫)।ইসলাম শুধু ধর্ম নয় একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। জামাতে নামাজ আদায় না করার জন্য যেমন কঠিন শাস্তি ও কঠোর হু'শিয়ারি দেয়া হয়েছে তেমনি কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতার কথাও বলা হয়েছে।তিনি (আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন) দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নাই।' (সূরা হজ্ব, আয়াত- ৭৮)।
জীবনর'ক্ষা শরিয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেন, আজান শোনার পর বিনা ওযরে যে ব্যক্তি নামাজের জামাতে শরীক হয় না তার একাকী নামাজ পড়া কবুল হবে না। জানতে চাওয়া হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ওজর বলতে কী বুঝায়? তিনি বললেন, বি'পদ অথবা রো'গব্যা'ধি। (আবু দাউদ, ইবনেমাজাহ)।এই হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে ন্যায় সঙ্গত ওজর আপত্তি থাকলে মসজিদে না গেলেও চলবে। এখন ভাবুন তো করোনা একজনের কাছ থেকে আরেকজনকে যেভাবে সং'ক্রমিত করছে এতে নিজের সুর'ক্ষার জন্য কি উপরিউক্ত হাদিস অনুসরণ করা যায় না? হযরত নাফি (র.) বর্ণনা করেন, প্রচ'ণ্ড এক শীতের রাতে হযরত ইবনে ওমর ( রা.) ‘যাজনান’ নামক স্থানে আজান দিলেন। অতপর তিনি ঘোষণা করলেন- সাল্লু ফি রিহালিকুম’ অর্থাৎ তোমরা আবাস স্থলেই নামাজ আদায় করে নাও।পরে তিনি আমাদের জানালেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরের অবস্থায় বৃষ্টি অথবা তী'ব্র শীতের রাতে মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বললেন এবং সাথে সাথে এ কথাও ঘোষণা করতে বললেন যে, তোমরা নিজ বাসস্থলে সালাত আদায় কর।’
(বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
ঘরে থেকেও জামাতে নামাজের সওয়াব
রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো বান্দা যদি কোনো নেককাজ নিয়মিত পালন করেন, অতঃপর কোনো রো'গ বা ভ্রমণের অপরাগতার কারণে সেই আমলে ছে'দ পড়ে, তাহলে গৃহ অবস্থানকালীন সুস্থতার দিনগুলোতে কৃত আমলগুলোর সমপরিমাণ সওয়াব তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ, কিতাবুল জানায়েজ,)।
একজন বিশ্বাসী নিজেকে বি'পদের মু'খে ঠেলে দেয় না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ইমানদারের জন্য সমীচীন নয় যে, সে নিজেকে লা'ঞ্ছিত করবে।’সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তখন প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যক্তি কীভাবে নিজেকে লা'ঞ্ছিত করে?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজেকে এমন দু'র্যোগের মু'খোমু'খি করা, যা সামলানোর ক্ষমতা তার নেই।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২২৫৪)।
হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে ভারী বৃষ্টির দরুন মসজিদে জামাত আদায় না করে বাড়িতে পড়ার দৃষ্টা'ন্তও রয়েছে। ইসলাম বাস্তবতা বুঝে সেই বাস্তবতার আলোকে চলতে বলে।
এদিকে মহামা'রীর এই পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আলেম ওলামারা সভা করেন।ওই সভায় ‘কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মহামা'রী ও দুর্যো'গকালীন সময়ে ইসলামের বিধি-বিধান অ'নুস'রণের’ ক্ষেত্রে মসজিদে নামাজের জামাতে উপস্থিতি সীমিত করার আহ্বান জানানো হয়। সভায় আলেম-ওলামারা দেশের মুসলমানদের উদ্দেশে চারটি আহ্বান জানান।
১. করোনাভাইরাস সং'ক্রমণ রোধে এবং মানুষের ব্যাপক মৃ'ত্যুঝুঁ'কি থেকে সুর'ক্ষার জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে সব ধরনের জনসমাগম বন্ধের পাশাপাশি মসজিদসমূহে জুমা ও জামাতে সম্মানিত মুসল্লিগণের উপস্থিতি সীমিত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
২. মসজিদ বন্ধ থাকবে না, তবে করোনাভাইরাস সং'ক্রমণ হতে সুর'ক্ষা নিশ্চিত না হয়ে মসজিদে গমন করবেন না।
৩. সরকার ও বিশেষ'জ্ঞগণ সত'র্কতার জন্য যেসব নির্দেশনা প্রদান করছেন তা মেনে চলার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
৪. সবাইকে অপরা'ধমূলক কাজকর্ম থেকে বিরত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে তওবা, ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াত অব্যাহ'ত রাখারও আহ্বান জানানো হয়।
যাদের হাঁচি, কাশি কিংবা জ্বর রয়েছে তাদেরকে বাসায় বসে জুমার পরিবর্তে জোহরের নামাজ পড়ার আহবান করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পাশাপাশি বয়স্ক মুসল্লিদের সং'ক্রমণ থেকে র'ক্ষা পেতে আপাতত কিছুদিন সব নামাজই বাসায় পড়তে অনুরোধ করা হয়েছে।
সুতরাং এই বিশেষ পরিস্থি'তিতে মসজিদে জামাতে বা জুমায় না এসে ঘরে নামাজ আদায় করাই উত্তম এবং শরীয়তসম্মত। এটাই উলামায়ে কেরামের অভিমত। যদিও কোন কোন আলেমের মতামত এর বিপরীতেও আছে।মসজিদ আমাদের আবেগ ও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মসজিদে না যেতে পেরে অনেক মুসলমান ভীষণ অতৃপ্তি আর অস্থি'রতায় ভু'গছেন। খুব শিগগিরই এই মুসি'বত থেকে আমরা রেহা'ই পাবো ইনশাআল্লাহ। আবারও মসজিদগুলো কানায় কানায় পরিপূর্ণ হবে, মসজিদে বিরাজ করবে বেহেশতি সৌরভ।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট