ইসলাম ডেস্ক: মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশ, নিষেদ অমান্য করে যে ব্যক্তি নিজের খেয়াল খুশি মতো চলে সেই ব্যক্তিকেই মহান আল্লাহ তায়ালা জালিম আখ্যা দিয়েছেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। চলুন আল কোরআনের আলোকে এ বিষয়ে বিস্তারীত জেনে নিই।
১। জালিম হলো আল্লাহ তায়ালার বিধানের বিপরীত বিচার-ফয়সালাকারী। এ অর্থে কুরআন মাজিদের একটি আয়াত, ‘আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমসমূহের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফয়সালা করে না তারাই জালিম’ (সূরা মায়িদা : ৪৫)। এখানে জালিম অর্থ আল্লাহ তায়ালার অবতীর্ণ কিতাবের বিপরীতে অন্য কোনো বিধিবিধান দ্বারা সমাজে বিচার ফয়সালাকারী বা তা রচনাকারী ।
২। আল্লাহ তায়ালার সাথে অংশীদার স্থাপনকারী ব্যক্তিকে জালিম বলা হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘স্মরণ করো, যখন লুকমান (আ) উপদেশচ্ছলে স্বীয় পুত্রকে বলেছিল, হে আমার ছেলে! আল্লাহর সাথে কোনো শরিক স্থাপন কোরো না। নিশ্চয়ই শিরক অতি বড় ধরনের জুলুমই বটে’ (সূরা লুকমান : ১৩)। এখানে শিরককে বড় ধরনের জুলুম এবং সে কারণেই শিরক সাবস্ত্যকারী মুশরিককে জালিম বলা হয়ে থাকে ।
৩। জালিম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি আপনি আহলে কিতাবদের কাছে সমুদয় নিদর্শন উপস্থাপন করেন, তবুও তারা আপনার কিবলা মেনে নেবে না এবং আপনিও তাদের কিবলা মানেন না। আপনার নিকট জ্ঞান আসার পরও যদি আপনি তাদের নিজেদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনি সেসব জালিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন’ (সূরা বাকারা : ১৪৫)। এখানে নিজেদের খেয়ালখুশির অনুসরণকারীদেরকে জালিম বলে অবিহিত করা হয়েছে ।
৪। জালিম হলো ভূমিদস্যু। অর্থাৎ যারা গায়ের জোরে অন্যের ভূমি দখল করে নেয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রাসূল সা:-এর বাণী, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে জুলুমের পথ অবলম্বন করে কারোর এক বিঘাত পরিমাণ জমি আত্মসাৎ করে কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক জমিন ঝুলিয়ে দেয়া হবে’ (বুখারি- ২৯৫৯)।
৫। জালিম হলো, আল্লাহ তায়ালার আদেশ অমান্যকারী। এ অর্থে কুরআন মাজিদের আয়াত, ‘এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু তোমরা কখনোই এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। তাহলে তোমরা জালিমদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (সূরা বাকারা : ৩৫)। হজরত আদম আ: শয়তানের কুমন্ত্রণায় ওই আদেশটি লঙ্ঘন করে জালিম সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
৬। জালিম হলো, উপহাসকারী, কাউকে অন্যায়ভাবে দোষারোপকারী এবং অন্যকে মন্দনামে আহ্বানকারী। এ অর্থে আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষের অপর কোনো পুরুষকে উপহাস করা উচিত নয়। কেননা যাকে উপহাস করা হলো সে তাদের থেকে উত্তমও হতে পারে এবং কোনো নারীর অপর কোনো নারীকেও উপহাস করা উচিত নয়। কেননা যাকে উপহাস করা হলো সে উপহাসকারিনী থেকে উত্তমও হতে পারে। তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি দোষারোপ করবে না এবং তোমাদের কাউকে মন্দ নামে ডাকবে না। ঈমান গ্রহণের পর মন্দ নামে ডাকা বড় পাপের কাজ। যারা এর থেকে ফিরে থাকবে না তারাই তো জালিম’ (সূরা হুজরাত : ১১)। এ আয়াতে জালিম বলে উপহাসকারী, কাউকে অন্যায়ভাবে দোষারোপকারী এবং অন্যকে মন্দ নামে আহ্বানকারীকে বুঝানো হয়েছে ।
৭। জালিম হলো, যারা ধর্মের ব্যাপারে মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকারী ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আল্লাহ তো তোমাদেরকে কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন। যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কারকরণে সাহায্য করেছে। এ ধরনের লোকদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই জালিম’ (সূরা মুমতাহানা : ৯)।
৮। আল্লাহ তায়ালার ঘর তথা মসজিদে আল্লাহর ইবাদত, তিলাওয়াত এবং জিকির-আজকারে বাধা দানকারীরাই জালিম। এ অর্থে মহান আল্লাহর বাণী, ‘তার থেকেও বড় জালিম আর কে, যে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার মসজিদে আল্লাহর নাম উচ্চারণে বাধা প্রদান করে এবং তা ধ্বংস সাধনে প্রচেষ্টা করে বেড়ায়? এ ধরনের লোকদের ইবাদতের ওই সব স্থানে ঢোকাই উচিত নয়। আর যদি যায় তাহলে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়ই যেন যায়। তাদের জন্য পার্থিব জীবনে অপমান, লাঞ্ছনা এবং পরকালীন জীবনে ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে’ (সূরা বাকারা : ১১৪)।
৯। জালিম হলো, সুদভিত্তিক অর্থনীতি তথা ব্যবসাবাণিজ্য, লেন-দেন ইত্যাদি পরিচালনাকারী। এ অর্থে মহান আল্লাহর বাণী, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। যদি প্রকৃত পে মুমিন হয়ে থাকো, আর যদি তা না করো তবে জেনে রেখো, এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এখনো যদি তাওবা কর এবং সুদ ছেড়ে দাও তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে। তোমরা জুলুম করবে না তাহলে তোমাদের ওপরও জুলুম করা হবে না’ (সূরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)।
১০। জালিম হলো তারা যারা মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে বাধা প্রদান করে, তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করে এবং আখিরাতকে প্রত্যাখ্যান করে। এ বিষয়ে কুরআন মাজিদের ঘোষণা, ‘যারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা দেয়, সে পথকে বাঁকা করে দিতে চায় এবং আখিরাত তথা আল্লাহর দরবারে প্রত্যাবর্তন অস্বীকার করে’ (সূরা হুদ : ১৯)।
১১। জালিম হলো, সেসব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যারা মানুষকে ভয়াবহ ‘নারের’ পানে তথা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী, ‘অতঃপর আমি তাকে ও তার সৈন্যবাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং সমুদ্রে নিপে করলাম। দেখে নাও, জালিমদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল। আমি তাদেরকে নেতা বানিয়ে ছিলাম আর তারা মানুষকে ভয়াবহ ‘নারের’ পানে আহ্বান করত। কিয়ামতের দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (সূরা কাসাস : ৪০-৪১)।
১২। আল্লাহ তায়ালার প্রতি মিথ্যা আরোপকারী ব্যক্তিও জালিম। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তার থেকেও বড় জালিম আর কে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যাচার করে অথবা সত্য তার সামনে এসে যাওয়া সত্ত্বেও তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? জাহান্নামই কি এ ধরনের কাফিরদের অবাসস্থল নয়?’ (সূরা আনকাবুত : ৬৮)।
১৩। যারা প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুস বিষয়কে উল্টিয়ে ফেলে মিথ্যার দেয়াল তৈরি করে তারাও জালিম। এ অর্থে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অথবা তোমরা কি বলছ যে, নিশ্চয়ই ইবরাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব আ: ও তাদের সন্তানগণ ইহুদি অথবা খ্রিষ্টান ছিল? আপনি বলে দিন, তোমরা বেশি জানো, না আল্লাহ বেশি জানেন? যে ব্যক্তি স্যা গোপন করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে?’ (সূরা বাকারা : ১৪০)।