ইসলাম ডেস্ক: শবেবরাত মূলত ক্ষমা চাওয়ার রাত, ভাগ্য পরিবর্তনের রাত। বিগলিত হৃদয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাকদিরও বদলে দেন বলে হাদিসে আছে। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) লিখেছেন, এক মূর্খ ব্যক্তি ইবাদত করে উচ্চ মাকামের অধিকারী হন এবং সব সময় আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে নিজের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। একদিন গায়েবি এক আওয়াজের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেয়া হলো-‘কান্নাকাটি করে লাভ নেই, তোমার ক্ষমা হবে না।’ এই আওয়াজ শুনে সে আরও অধীরচিত্তে আল্লাহর শরণাপণ্ণ হন।
এই ঘ'টনা লোকে জানাজানি হলে সবাই তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘যখন তোমাকে ক্ষমা করা হবে না বলে জানিয়েই দেয়া হয়েছে, তখন এত ইবাদতে কী লাভ?’
উত্তরে লোকটি বললেন, ‘আমার কাজ আমি করছি। আমার তো অন্য কোথাও যাওয়ার ঠাঁই নেই। আমার কাজ আমাকে করতেই হবে।’ সেই মুহূর্তে গায়েবি আওয়াজে তাকে আবারও জানিয়ে দেয়া হলো, ‘যদিও তোমার মধ্যে কোনো ক্ষমাযোগ্য আমল নেই, কিন্তু তুমি আমাকে ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় চাওনি, তাই তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।’
বুখারি শরিফের এক হাদিসেও এমন একটি ঘ'টনা পাওয়া যায়। হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি মৃ'ত্যুর সময় সন্তানদের অসিয়ত করে গেলেন মৃ'ত্যুর পর যেন তাকে দাফন না করে আগুনে জ্বা'লিয়ে দেয়া হয়। এরপর ছাইগুলো বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হয়। কারণ, লোকটি ছিল তার ভাষায় মা'রাত্ম'ক অপরা'ধী। তার মতো অপরা'ধী দ্বিতীয় কেউ নেই। আল্লাহর সামনে যেন তাকে না দাঁড়াতে হয়, এজন্য তিনি দাফন না করে আগুনে জ্বা'লিয়ে দেয়ার অসিয়ত করেছেন।
অসিয়ত অনুযায়ী মৃ'ত্যুর পর লোকটিকে তাই করা হলো। এরপর আল্লাহর হুকুমে বাতাসে উড়তে থাকা ছাইগুলোকে একত্র করে আবার তাকে মানবাকৃতিতে আল্লাহর সামনে দাঁড় করানো হলো। তাকে বলা হলো, ‘কেন তুমি এই খোদাদ্রো'হী অসিয়ত করেছ? আমি কি ছাই থেকে তোমার দেহ উপস্থিত করতে সক্ষম নই?’
লোকটি উত্তর দিলো, ‘হে আল্লাহ, আপনি তো জানেন, আমি বড় গোনাহগার। আমার অপরা'ধ, বিশ্বা'সঘাতক'তা ও অকৃতজ্ঞ চেহারা নিয়ে কীভাবে আপনার সামনে দাঁড়াব, আপনার আজাবের ভ'য়েই আমি এই অসিয়ত করেছিলাম। কিন্তু আপনি তো ক্ষ'মাকারী। আমার অপরা'ধকে মার্জনা করবেন।’
তখন আল্লাহ বলেন, ‘তোমার অন্তরে অনুতা'প ও আমার ভী'তি রয়েছে, যার অন্তরে আমার ভ'য় থাকে তাকে ক্ষমা করার কথা আমি ওয়াদা করেছি। তাই আজ আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।’
শবেবরাতের রাত এমনই এক উন্মু'ক্ত ক্ষ'মা ঘোষণার রাত। এ রাতে জমিনে অসংখ্য ফেরেশতারা আসেন।কত ফেরেশতা আসেন, হাদিসে তার কোনো পরিসংখ্যান যদিও নেই।কিন্তু বাইতুল মামুরে প্রতি রাতেই ৭০ হাজার ফেরেশতা আসেন। যেই ফেরেশতা একবার আসেন, তাকে আর দ্বিতীয়বার আসতে হয় না। এতেই বোঝা যায়, কুল মাখলুকাতের তিনগুণ বেশি হলো ফেরেশতারা। ফেরেশতারা এসে বান্দাদের যাবতীয় আমল পর্যবেক্ষ'ণ করেন।
হাদিসে আছে, আল্লাহ পাক সমবেত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। ফলে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে বলেন, ‘আল্লাহ ওই লোকটা তো এমনিতেই বসে আছে। তার ক্ষমা কেন?’ আল্লাহ বলেন, ‘আমার প্রিয় বান্দার সহচ'র্যে যারা থাকে, তাদের সম্মানে আমি তাদের সঙ্গে সমবেত লোকদেরও ক্ষ'মা করে থাকি।’
এ কারণে শবেবরাতের প্রথম কাজ হলো, বিগত জীবনের সকল ত্রু'টি-বি'চ্যু'তি ও গোনাহ্ থেকে অনুত'প্ত হয়ে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাওয়া। এবং ভবিষ্যতে গোনাহ না করার প্রতিশ্রুতিব'দ্ধ হওয়া। এরপর রাত ঘন হয়ে আসলে যতদূর মনে পড়ে কাজা নামাজ আদায় করে নেয়া। দিন তারিখ মনে থাকলে অনুমান করে কাজা নামাজ আদায় করে নেয়া, নফল নামাজ পারতপক্ষে বেশি বেশি পড়া। মধ্যরাত হলে তাহাজ্জুতের নামাজ অথবা সালাতুস তাসবিহ আদায় করে নেয়া।
এ রাতে কোরআন তেলাওয়াত করারও বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। কোরআন তেলাওয়াতের বরকত অনেক বেশি। আল্লাহকে সন্তু'ষ্ট করা এবং তার মহব্বতের অধিকারী হওয়ার অন্যতম উপায় হলো কোরআন তেলাওয়াত করা। যতটুকু পারা যায় তেলাওয়াত করা। তেলাওয়াত না পারলে কোনো সুরা জানা থাকলে সেটাই পড়া।
সময় সুযোগে বরাতের রাতে জিকির এবং তাসবিহ পাঠ করাও উত্তম কাজ। এর দ্বারা একদিকে আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে বান্দার গভীর সম্পর্ক স্থাপন হয়। অন্যদিকে অন্তরেও প্রভূত শান্তি লাভ হয়। হাদিসে আছে, যে কোনো আমল ও দোয়ার পূর্বে দরুদ পাঠ করলে তা কবুল হয়ে যায়। আরেক হাদিস মতে, একবার দরুদ পাঠ করলে কমপক্ষে দশটি রহমত নাজিল হয়। শবেবরাতের রাত দরুদ ও জিকিরের উপযুক্ত সময়। কাউকে ক'ষ্ট না দিয়ে কারোর আমলের ক্ষ'তি না করে কমপক্ষে ১০০বার দুরুদ শরিফ এবং এক হাজার বার যে কোনো তাসবিহ অথবা আল্লাহর জিকির করা।
এ রাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো, কবর জিয়ারত করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরাতের রাতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে কবর জিয়ারত করতেন। এই কবর জিয়ারতের মাধ্যমে মানুষের মনে পরকালীন ভাবনা আসবে এবং পরকালের প্রস্তুতি নিতে মন উদগ্রী'ব হবে।
সবশেষে আল্লাহর কাছে সমর্পিত হওয়া। আল্লাহর কাছে সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর চলা ও ঈমানের ওপর মৃত্যুর জন্য দোয়া করা। রিজিক ইত্যাদি সম্পর্কে আজ রাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলেও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। তবে রিজিকের প্রশস্ততা নির্ভর করে হালাল হারামের বিধি-নিষেধের ওপর। হারামকে বর্জন করে হালাল তরিকায় উপার্জনকে বিশেষ ইবাদত এবং জান্নাতে যাওয়ার উপায় হিসেবেও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। তাই এ রাতে হালাল উপার্জনের জন্য দোয়া করারও বিশেষ ফজিলত আছে।
আল্লাহ তায়ালা সবাইকে শবেবরাতের সঠিক শুদ্ধ আমলের মাধ্যমে এ রাতের পূর্ণ ফজিলত হাসিলের তাওফিক দান করুন।
লেখক: খতিব, গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ ও জামিয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ীর প্রিন্সিপাল