সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৮:৪৮:৫২

রমজান মাসে মহানবী (সা.) রাত জেগে যে আমল করতেন

রমজান মাসে মহানবী (সা.) রাত জেগে যে আমল করতেন

ইসলাম ডেস্ক: আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) রাত জেগে মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে মোশগুল থাকতেন। হাদিসে এসেছে—রাসুল রাতে এগারো কিংবা তেরো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। উম্মুল মোমিনীন আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে—রাসুল রমজান কিংবা অন্য সময়ে এগারো রাকাতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। [বোখারি : ১১৪৭।]

অন্য এক হাদিসে আয়েশা রা. বর্ণনা করেন : রাসুল রাতে তেরো রাকাত সালাত আদায় করতেন। অত:পর ভোরের আজান শ্রুত হলে সংক্ষেপে দু রাকাত সালাত আদায় করতেন। [বোখারি : ১১৬৪।]

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে এসেছে, এক রাত্রিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নামাজ পড়লেন, তার সাথে লোকজনও নামাজ পড়ল। পরের রাত্রিতে আবার নামাজ আদায় করলেন লোকজন পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেল। অতঃপর তৃতীয় ও চতুর্থ রাত্রিতেও লোকজন জমায়েত হলো কিন্তু রাসূল স. বের হলেন না। ভোরে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—

قد رأيت الذي صنعتم، فلم يمنعني من الخروج إليــكم إلا أني خشيت أن تفرض عليكم، وذلك في رمضان. متفق عليه

তোমরা যা করেছ আমি দেখেছি। তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আমি বের হইনি। আর এ ঘটনা ঘটেছিল রমজান মাসে। (বোখারি ১২৯, মুসলিম ১৭৭)

আবু যর রা. হতে বর্ণিত একটি হাদিসে পাওয়া যায়।-

إن الرجل إذا صلى مع الإمام حتى ينصرف حسبت له قيام ليلة. أبوداود، الترمذي ، النسائي ،ابن ماجة .أحمد في المسند.

অর্থ : যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (কিয়ামুল লাইল করবে) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের ছাওয়াব দান করা হবে। রাসূল আমাদের নিয়ে চতুর্থ রাত্রিতে কিয়ামুল লাইল করেননি। তৃতীয় রাতে তার পরিবার, স্ত্রী গণ, ও লোকজনকে জমা করলেন এবং আমাদের সাথে নিয়ে সেহরির শেষ সময় পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল করলেন, এমনকি আমরা চিন্তিত ছিলাম সেহরি খেতে পারব কিনা ? অতঃপর মাসের বাকি রজনিগুলোতে আমাদের নিয়ে আর কিয়ামুল লাইল করেননি। (আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ি, ইবনে মাজা, আহমদ)

তারাবীহের নামাজ ইমামের সাথে আদায় করা, ইমাম নামাজ শেষ না করা পর্যন্ত তার সাথে থাকা বিশেষভাবে বাঞ্ছনীয়। তাহলে সে পুরো রাত কিয়ামুল লাইল করার সওয়াব পাবে, যেমন আবু যর রা.-এর হাদিস জানা যায়। তারাবীর নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলেমদের বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। কারো মত : ৪১ রাকাত, কারো মত : ৩৯ রাকাত, কারো মত : ২৩ রাকাত, কারো মত : ১৩ রাকাত, কারো মত : ১১ রাকাত। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—

ما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزيد في رمضان ولا غيره على إحدى عشرة ركعة، يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعا فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي ثلاثا…( متفق عليه)

অর্থ—রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান কিংবা অন্য কোন সময়ে এগারো রাকাতের অধিক (রাতে) আদায় করতেন না। (প্রথমে) তিনি চার রাকাত আদায় করতেন, তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হত অতুলনীয়। অত:পর চার রাকাত আদায় করতেন, তারও সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হত অতুলনীয়। অত:পর আদায় করতেন তিন রাকাত…। (বোখারি ১১৪৭, মুসলিম ১২৫)

রাসুল কখনো পূর্ণ রাত্রি সালাতে জাগরণ করতেন না। কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু সময় কাটাতেন। আয়েশা রা. বর্ণিত হাদিসে এসেছে—

ولا أعلم نبي الله صلى الله عليه و سلم قرأ القـرآن كـله في ليـلة، ولا قام ليلة حتى أصـبح، ولا صام شهراً كاملاً غير رمضان.

রমজান ব্যতীত কোন রাত্রিতে আমি রাসুলকে পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোজা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখিনি। [আহমদ : ২৪২৬। সহিহাইনের শর্ত মোতাবেক তার সূত্রটি শুদ্ধ।]

ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত : জিবরাইল আ. রমজানের প্রতি রাতে ভোর অবধি রাসুলের সাথে কাটাতেন। রাসুল তাকে কোরআন শোনাতেন। [বোখারি : ১৯০২।] রাসুল যদি সে রাতগুলোতে পূর্ণ সময় ব্যয়ে কিয়ামুল লাইল করে কাটিয়ে দিতেন, তবে জিবরাইল আ.-এর সাথে কোরআন অনুশীলনে সময় পেতেন না।

এবাদতের এ পদ্ধতি শরীরের জন্য অনুকূল, মন এতে অংশ নেয় স্বত:স্ফূর্তভাবে। এর ফলে ব্যক্তির জন্য পরিবারের হক আদায় সম্ভব হয় ; এবাদতে অব্যহততা আনা যায়, সহনীয়ভাবে, ক্রমশ: দ্বীনের মাঝে প্রবেশ সহজ হয়। নফ্স হঠাৎ বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে না। অধিক কিন্তু বিচ্ছিন্ন এবাদতের তুলনায় পরিমাণে স্বল্প ও অব্যাহত ইবাদত কল্যাণকর ও আল্লাহর নিকট প্রিয়।

অধিকাংশ সময় রাসুল—উম্মতের জন্য ফরজ করে দেয়া হবে এ আশঙ্কায়—রাতে একাকী সালাত আদায় করতেন। আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—

كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يصلي في رمضان، فجئت فقمت إلى جنبه، وجاء رجل آخر فقام أيضاً، حتى كنا رهطاً، فلما حسَّ النبي صلى الله عليه و سلم أنَّا خلْفه جعل يَتَجوَّز في الصلاة، ثم دخل رحله فصلى صلاة لا يصليها عندنا، قال: قلنا له حين أصبحنا: أفطنت لنا الليلة؟، قال: فقال: نعم، ذاك الذي حملني على الذي صنعت.

রাসুল রমজানে (রাতে) সালাত আদায় করতেন। একদিন আমি এসে তার পাশে দাঁড়ালাম, অত:পর এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল—এভাবে কিছুক্ষণের মাঝে আমরা একটি দলে পরিণত হলাম। রাসুল যখন বুঝতে পারলেন যে, আমরা তার পিছনে দাঁড়ানো, তখন সংক্ষেপে সালাত আদায় করতে লাগলেন। অত:পর তিনি তার গৃহে প্রবেশ করে একাকী সালাত আদায় করলেন। প্রত্যুষে আমরা তাকে বললাম : আপনি রাতে আমাদের সাথে কৌশল করেছেন ? তিনি বললেন, হ্যা। আমি তোমরা জড়ো হওয়ার ফলেই আমাকে কৌশল করতে হয়েছে। [মুসলিম : ১১০৪।]

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :—

أن رسول الله صلي الله عليه و سلم خرج من جوف الليل فصلى في المسجد فصلى رجال بصلاته؛ فأصبح الناس يتحدثون بذلك، فاجتمع أكثر منهم، فخرج رسول الله صلي الله عليه و سلم في الليلة الثانية فصلوا بصلاته؛ فأصبح الناس يذكرون ذلك، فكثر أهل المسجد من الليلة الثالثة، فخرج فصلوا بصلاته، فلما كانت الليلة الرابعة عجز المسجد عن أهله، فلم يخرج إليهم رسول الله صلي الله عليه و سلم، فطفق رجال منهم يقولون: الصلاة، فلم يخرج إليهم رسول الله صلي الله عليه و سلم حتى خرج لصلاة الفجر، فلما قضى الفجر أقبل على الناس، ثم تشهد فقال: أما بعد: فإنه لم يَخْفَ علي شأنكم الليلة، ولكني خشيت أن تفرض عليكم صلاة الليل فتعجزوا عنها.

এক রাতে রাসুল গৃহ হতে বেরিয়ে মসজিদে সালাত আদায় করলেন। কয়েক ব্যক্তি তার সাথে সালাত আদায় করল। পরদিন সকলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হল, ফলে পূর্বের তুলনায় অধিক লোক সমাগম হল। দ্বিতীয় রাত্রিতেও রাসুল আগমন করলে লোকেরা তার সাথে সালাত আদায় করল, সকলে এ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিল। তৃতীয় রাত্রিতে পূর্বেরও অধিক লোকসমাগম হল। রাসুল বের হলে সকলে তার সাথে সালাত আদায় করল। চতুর্থ রাত্রিতে এত মুসল্লি হল যে, মসজিদ তাদের ধারণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ল। কয়েক ব্যক্তি ডেকে বলল : সালাত ! কিন্তু, রাসুল ফজরে সালাতের পূর্বে বেরুলেন না। ফজরের সালাত আদায়ের পর তিনি সকলের দিকে ফিরে তাশাহুদ পাঠ করে বললেন : গত রাতের ঘটনা আমার অবিদিত নয়। কিন্তু, আমি আশঙ্কা করেছি যে, তোমাদের উপর রাতের সালাত ফরজ করা হবে, তোমরা তা আদায়ে অপরাগ হয়ে পড়বে। [বোখারি : ১১২৯। মুসলিম : ৭৬১।]

কোরানে এসেছে—

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ.

অবশ্যই তোমাদের মাঝে, তোমাদের থেকেই একজন রাসুল আগমন করেছেন, যা তোমাদেরকে বিপন্ন করে, তা তার জন্য কষ্টদায়ক, সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের জন্য দয়ার্দ্র, ও করুণাময়। [সূরা তওবা : আয়াত, ১২৮।]

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে