ইসলাম ডেস্ক : তারাবীহ অর্থ আরাম,অবসর,বিশ্রাম,বিরতি। শরীয়তের পরিভাষায় রমজানুল মোবারকের রাতে এশার নামাজের পর যে নামায পড়া হয় তাকে তারাবীহ’র নামায বলা হয় ।
والتراويح جمع ترويحة وهى فى الاصل مصدر بمعنى الستراحة سميت به الاربع ركعات المخصوصة لاستلزامها استراحة بعدها كما هوا السنة فيها
অর্থাৎ-প্রতি চার রাকাত নামাযের পর সম পরিমাণ সময় আরাম বা বিশ্রাম নেয়া হয় বলে একে সালাতুত তারাবীহ্ বলা হয়। এ সময়টুকু বিশ্রাম নেয়া বা বিরতি দিয়ে পড়া সুন্নত। দ্রঃ বাহরুর রাঈক্ব খন্ড ২ পৃষ্ঠা ৬৬
তারাবীহ্র মর্ম : তারাবীহ্র মর্মকথা বা আসল উদ্দেশ্য রমজানের রাতে জেগে থেকে ইবাদতি করা। ইমাম আল হাফিয ও আল কিরমানী এই মত প্রকাশ করে বলেছেন-
قال الحافط المراد من قيام الليل ما يحصل به مطلق القيام كما قدمناه فى التهجد سواء. وكذا النووى ان المراد بقيام رمضان الصلوة التراويح.. واغرب الكرمانى فقال اتفقو على ان المراد بقيام رمضان صلوة التراويح
তারাবিহ‘র নামায কত রাকাত : প্রসিদ্ধ চার ইমাম সহ জমহুর (প্রায় সকাল) উম্মত এ ব্যাপারে একমত যে তারাবীহ্র নামায কম পক্ষে ২০ রাকাত। ইমাম মালিক (রঃ) এর একটি বর্ণনা মতে তারাবীহ ৩৬ রাকাত এবং অপর বর্ণনায় ৪১ রাকাতও পাওয়া যায় তৃত্বীয় আরেক বর্ণনায় জমহুর উম্মতের মতই ২০ রাকাত পাওয়া যায় এর মধ্যে ৪১ রাকাতের সাথে তিন রাকাত বেতের আর দু রাকাত নফল অর্থাৎ ৪১ থেকে ৫ বিয়োগ হলে ৩৬ রাকাত ই অবশিষ্ট থাকে যা তারাবীহ হিসাবে গন্য। এরপর বাকী রইল ২০ রাকাত এবং ৩৬ রাকাতের দুটি বর্ণনা। এর বিস্তারিত বেদায়াতুল মুজতাহিদ কিতাবে ইমাম মালিক (রাঃ) বর্ণিত ৩৬ রাকাত ও ২০ রাকাতের এভাবে দেয়া হয়েছে যে, মক্কার মুসলমানদের সর্বদাই আমল ছিল যে তারা ২০ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। কিন্তু তারা তারাবীহ‘র প্রতি চার রাকাত অন্তর অন্তর যে বিরতি দেয়া হত এ সময়ে ১ টি তওয়াফ সেরে ফেলতেন। অন্যদিকে মদীনার মুসলমানদের তওয়াফের সুযোগ না থাকায় তারা এ সময়ে আরো ৪ রাকাত পড়ে নিতেন। এ জন্য মদীনা বাসীর হয়ে যেত ২০+১৬ = ৩৬ রাকাত। এতে প্রমানিত হয় তারাবী ২০ রাকাতই এবং এর উপর চার ইমামই একমত। (দ্রঃ ফতোয়া এ ইবনে ক্বাদামা খন্ড-২ পৃষ্ঠা ১৬৭ বাহরুর রাইক্ব খন্ড ২ পৃষ্ঠা-৬৬ মাআরিফুস সুনান খন্ড ৬ পৃষ্ঠা-২২১ দারসে তিরমিয়ি ২য় খন্ড
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা হাবিবুর রহমান আযমী রাকাত এ তারাবীহ্ গ্রন্থের ৬১-৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষক পন্ডিতগন একথা স্পষ্ট করেছেন যে তারাবীহ্র নামায ২০ রাকাতই পড়া হত মক্কা মদীনায় কিন্তু সওয়াবের দৌড়ে মক্কাবাসী তওয়াফের মাধ্যমে অনেক এগিয়ে যাচ্ছেন এই ভাবনায় মদীনার লোকেরা প্রতি চার রাকাত অন্তর একাকী আরো চার রাকাত পড়ে নিতেন। তাই ২০+১৬=৩৬ রাকাত হয়ে যেত। এতদ্ব্যাতীত এটাও প্রামানিত যে তারা জামাত শেষে রাতের শেষাংশেই এই ১৬ রাকাত পড়তেন। সুতরাং এটাই সত্য যে ইমাম মালিক (রঃ) তার বর্ণনায় ২০ রাকাত তারাবীহ্র সাথে মদীনাবাসীর অতিরিক্ত ১৬ রাকাতের কথাও বাদ দেন নি। ইমাম মালিক (রঃ) তার বর্ণনায় ২০ রাকাত তারাবীহ্র সাথে মদীনাবাসীর অতিরিক্ত ১৬ রাকাতের কথাও বাদ দেন নি।
ইমাম মালিক (রঃ) এর চতুর্থ আরেকটি বর্ণনায় বেতের সহ ১১ রাকাতের কথা পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে আল্লামা শামী (রঃ) এবং আবু বকর আল-আরবী বলেছেন এটা তার ব্যক্তিগত আমল ছিল বা থাকতে পারে। (দ্রঃ উমদাতুল ক্বারী) এদিকে তুহফাতুল আহওয়াযী গ্রন্থাকার এই বর্ণনার গুরুত্বই বেশী দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হাবীবুর রহমান আযমী (রঃ) তার গ্রন্থের ৮৪-৮৮ পৃষ্ঠায় এর বিশদ আলোচনা করে একথা স্পষ্টই প্রমাণ করেছেন যে এই বর্ণনাটি কোন অবস্থায়ই ইমাম মালিক (রঃ) এর বর্ণনা বা তার মত হিসাবে গন্য করা ঠিক নয়।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাঃ) : প্রখ্যাত মুজতাহিদ চার মুযহাবের বাইরে সর্বাধিক,আলোচিতও খ্যাতনামা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাঃ) এবং তার অনুসারী বিশেষত আমাদের সময়কার গায়র মুকাল্লিদীন (লা মাযহাবী) লোক প্রায় সকল উম্মতের ঐক্যমতের সাথে বিভেদ সৃষ্টি করে ৮ রাকাত তারাবীহ্র করে থাকেন। তারাবীহ সম্পর্কে আরো অনেক প্রশ্নও তুলেন। ৮ রাকাত ওয়ালাদের উত্থাপিত নানা প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) এ সম্পর্কে কি বলেছেন তার পর্যালোচনা এবং সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা দরকার। তারাবীহ্র নামাযের রাকাত সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) এর একাধিক বক্তব্য ও মতামত পাওয়া যায়। যথা- রমজান এবং রমজানের আগে পরে রাসুল (সাঃ) ৮ রাকাত এবং ৩ রাকাত বেতের নামায পড়তেন। ৮ রাকাত নামায এতো দীর্ঘ হতো যে কখনো রাত অর্ধেক কখনো দুই তৃতত্বীয়াংশ এবং কখনো সেহরীর সময় শেষ হওয়ার উপক্রমক দেখাদিত। সুতরাং ক্বিয়ামে রমজানের আলাদা কোন নামায ছিলনা। এর প্রমাণ হযরত আয়েশা (রাঃ) এবং আবু যর (রাঃ) এর বর্ণিত দুটি হাদীস।
(ক) ১০ রাকাত তারাবীহ এবং ৩ রাকাত বেতের সহ ১৩ রাকাত।
(খ) ২০ রাকাত তারাবী এবং ১৬ রাকাত অতিরিক্ত ৩ রাকাত বেতের ২ রাকাত নফল সহ মোট ৩৬ ও (গ) রাকাত কিয়ামে লাইল।
(ঘ) অধিকাংশ উম্মত এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের ঐক্যমত ২০ রাকাত তারাবীহ এবং ৩ রাকাত বেতের।
(ঙ) তারাবী ৮ রাকাত এবং ৩ রাকাত বেতের মোট ১১ রাকাত কিয়ামে লাইল যা ইমাম মালিক (রঃ) এর বর্ণনা।
(চ) মুসল্লিদের অবস্থা বিবেচনায় ২০ রাকাত অথবা ৪১ রাকাত বা ১৩ রাকাত পড়া যাবে যাতে মুসল্লিরা বিরক্ত না হন।
(ছ) উম্মাহর ঐকমত্য হলো ২০ রাকাত বিধায় ৪১ আর ১১ এর মধ্যবর্তি ২০ রাকাতই উত্তম পন্থা। সর্বোপরি মুসল্লিদের অবস্থা বিবেচনা করে এবং একাকিত্বে নিজের মন ও শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে যে কোন এক পন্থা গ্রহণ করা যায়।
দ্রঃ মাজমুআ এ ফতোয়াই ইবনে তাইমিয়া ২২ খ ফতোয়াতুল কুবরা খন্ড ১ পৃষ্টা ১৭৬ মুজমুআ জাওয়ায়েদ খন্ডত পৃষ্ঠা ১৭২
মুহাদ্দিস হাবিবুর রহমান আযমী তার গ্রন্থে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে ইমাম ইবনে তাই মিয়া (রঃ) ২০ রাকাতকেই মধ্যম পন্থা। এবং উম্মতের ঐকমত্য হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন বিধায় এ ব্যাপারে আর কোন নতুন ইখতিলাফ করা ঠিক নয়্ হাদীসের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণেই তার মতামত গুলো ব্যক্ত করতে একাধিক মত পরিলক্ষিত এবং আট রাকাতের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মনে হলেও তিনি একাধিকবার বলেছেন যে ২০ রাকাতের উপর উম্মত ঐকমত্য সুতরাং-২০ রাকাত সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে আর কোন সংশয় তার উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না।
والتراويح ان صلاّهاكمذهب ابى حنيفة والشافغى واحمد عشرين ركعته او كمذهب مالك ستاوثلاثين اوثلاث عشرة اِحدى عشرة فقدأحسن ….وكذا فى الفتاوى الكبرى لابن تيميه قد جاء مصرحا فى السنن انه لما صلى بهم قام رمضان بعدالعشاء وكان النبى صلى الله عليه و سلم قيامه بااليل هو وتره يصلى بالليل فى رمضان وغير رمضان… قد ثبت ان ابى ابن كعب كان يقوم بالناس عشرين ركعة فى قيام رمضان ويؤتر بالثلاث..
মুফতি তক্বী উসমানী ঃ বেশ গবেষণার পর এটাই সাব্যস্থ করতে সক্ষম হয়েছেন যে ২০ রাকাত তরাবীহ সুন্নাত। তিনি লিখেছেন এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত জনার জন্য এই মসলকের সমর্থিত দলীল প্রমাণ ভিত্তিক কিতাব তোহফাতুল আহওয়াযী খন্ড ২ পৃষ্ঠা ৭২-৭৬ দেখা যেতে পারে।
শায়খ ইবনে হুমাম (রঃ): তারাবীহ্র নামায কত রাকাত এ প্রশ্নে শায়খ ইবনে হুমাম (রঃ) জমহুর উম্মতের মতামতের সাথে একমত পোষন না করে ৮ রাকাতকে প্রধান্য দিয়েছেন। যদিও তিনিই আবার ২০ রাকাত তারাবীহকে সুন্নতে খোলাফা এ রাশেধীন মেনে লিখেছেন এগার রাকাতের মধ্য দিয়েই ক্বিয়ামে রমজান হাসিল হয়ে যায় বেতের সহ জামায়াতের সাথে। রাসুল (সাঃ) তাই করেছেন এবং অসুবিধা জনিত কারনে ছেড়েছেনও। মুসল্লিদের কষ্টও বিবেচনায় ছিল। আর এভাবেই চলছিল তাঁর ইন্তেকাল অবদি। তাই এটাই সুন্নত আর ২০ রাকাত সুন্নত খোলাফা ই রাশিদীন এর। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাাহ (সাঃ) বলেছেন তোমাদের প্রতি আমার সুন্নত এবং খোলাফা এ রাশিদীনেরও সুন্নত (সমান প্রযোজ্য)। দ্রঃ ফহহুল কাদির খন্ড ১ , পৃষ্ঠা- ৩৩৪
তবে আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রঃ) ফাতহুল কাদিরের এসব বকতব্য দলীল প্রমানের ভিত্তিতে অগ্রহনযোগ্য এবং ইজমা এ উম্মতের বিপরিত সাব্যস্থ করেছেন। তার প্রতিটি বাক্যের সাথে নির্ভর যোগ্য দলীলও রয়েছে। (দ্রঃ আলাউসসুনান খন্ড ৭ পৃষ্ঠা ৬৮-৭২ তারাবীহ অধ্যায় )