ইসলাম ডেস্ক : মোনাজাত কী? যা করলে নাজাত (মুক্তি) পাওয়া যায় তাই মোনাজাত। মাওলানা লালপুরীর ভাষায়, মনের কল্পনা ও গভীর ব্যথাকে আল্লাহ্পাকের নিকট নিজ ভাষায় ব্যক্ত ও কাতরস্বরে প্রকাশ করাকে মোনাজাত বলে। মোনাজাত মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। দুনিয়ার তথা কথিত মালিক-মনিবদের কাছে কিছু দাবি করলেই তারা বেজার হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ খুশি হয়ে যান। আল্লাহ্ বলেন, উদঊনি আস্তাজিব লাকুম। আমাকে ডাকো আমি তোমার ডাকে সাড়া দেব অর্থাৎ যে উদ্দেশে আমাকে ডাকছে তা আমি তাকে দেব এবং তাই দেব তোমার কল্যাণ হবে এমনভাবে তোমার পছন্দমতো নয়। শিশু যেমন মায়ের কাছে আচার, চাটনি, চকলেটের আবদার করে মা শিশুকে তাই দেয় যা তা পেটে সইতে পারে, শিশুর পছন্দ মাফিক দিলে বদহজম হয়ে স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। তো আমরা জানি না কোন জিনিস আমাদের জীবনের জন্য উত্তম হবে তাই মোনাজাতে বলব হে আল্লাহ যা আমাদের জন্য কল্যাণকর তা আমাদের দিয়ে মালামাল করে দাও। আমাদের চাওয়ায় ভুল হতে পারে তোমার হেকমত ও দয়ায় আমাদের ভুলকে শুদ্ধ করে আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করো।
এই বিষয়টিই দেখি জাদ্দুল আম্বিয়া মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহীম আ. কর্তৃক খানায়ে কাবা নির্মাণ শেষে তিনি দোয়া করেন, রাব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না, আয় আল্লাহ তোমার উদ্দেশে বানানো ঘর তোমার হাওলা করে দিলাম তা তুমি কবুল করে নাও। ইন্নাকা আন্তাস সামিউল আলীম, নিশ্চয় তুমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা শুনে থাকো। রাব্বানা ওয়াবয়াস ফীহিম রাসূলা, হে আল্লাহ পাকপরোয়ার আমার এই কাজের বিনিময়ে আমার আওলাদের মধ্যে রাসূল পাঠাও। ইয়াতলু আলাইহিম আয়াতিকা যিনি তোমার আয়াতসমূহ সদা পাঠ করবে। ওয়া ইয়ু আল্লিমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাত, আর মানুষকে তোমার কিতাব শিক্ষা আর হিকমত দীক্ষা দেবে। ওয়াইয়ু যাক্কিহিম, আর এই শিক্ষা দীক্ষায় তাদের বাহ্যিক ও আত্মিকভাবে পবিত্র করবে। ইন্নাকা আন্তাল আজীজুল হাকীম, নিশ্চয় তুমি প্রেমময় বন্ধুবৎসল এবং অতিশয় জ্ঞানী। যদি আমার চাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে তোমার প্রজ্ঞা দিয়ে তা দূর করে আমার মোনাজাত কবুল কর।
এমন একটি হৃদয় নিংড়ানো মোনাজাতের প্রেক্ষিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবতার মুক্তিদূত নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহকে তার বংশধারায় পাঠিয়ে মানুষকে নেয়ামতে মালামাল করেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ইব্রাহিম আ.-এর মোনাজাতের ভাষার প্রয়োগগত ত্র“টিও দূর করে নেয়ামতের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ্ বলেন, ‘লাক্বাদ মান্নাল্লাহু আলাল মু’মিনিনা ইজ বাআসা ফীহিম রাসুলাম মিন আনফুসিহিম।’ আল্লাহ্ মুমিনদের নেয়ামতে পরিপূর্ণ করেছেন তাদের মধ্য থেকেই নবী মোহাম্মদকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়ে। ‘ইয়াতলু আলাইহিম আয়াতিহি ওয়া ইয়ু যাক্কিহিম’ যিনি আল্লাহ্র আয়াতগুলো তিলাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরকে পাকসাফ করে আল্লাহ্র প্রেম-প্রজ্ঞা ও হেকমতের জন্য উপযোগী করে নেবেন। ‘ওয়া ইয়ু আল্লিমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাতা’ এবং এরপরই তাকে আল্লাহর কিতাবী জ্ঞান ও হিকমত শিক্ষা দেবেন। এজন্যই দেখা যায় নবুয়তের শুরুতে মানুষকে কোরআনের তেলাওয়াতই শিক্ষা দেয়া হতো যাতে মানব সমাজ উত্তম আদর্শের মানুষগুলোর নাগাল পায়। যার ফলে আমরা আলী, আবু বকর, উসমান, উমর, বেলাল, সালমান, খোয়াইব, খাব্বাব, শোহাইব, রুমির মতো আসহাবে রাসূলের সন্ধান পাই।
সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে কোনো পাত্র যথাযথ পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ না করে যত ভালো জিনিসই রাখা হোক না কেন পাত্রে দোষের প্রভাবে তা দূষিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার এক ঘি বিক্রেতার ঘটনা মনে পড়ে যায়। লায়ন থিয়েটারের পাশে ইসলামপুর রোডে এক ঘোষের দোকান ছিল, যার বিশুদ্ধ ঘি তৈরির খ্যাতি ছিল শহর জোড়া। তিনি কাচের বৈয়াম ছাড়া কোনো পাত্রে ঘি সরবরাহ করতেন না। একদা এক গ্রাহক ঘি কেনার জন্য বৈয়াম নিয়ে এলে ঘ্রাণ শুঁকে বলেন এ পাত্রে ঘি দেয়া যাবে না, ভালো করে ধোয়া এবং রোদে শুকানো বৈয়াম নিয়ে আসুন নতুবা ৩ ঘণ্টা পড়ে আসুন আমি নিজে এটি ধুয়ে শুকিয়ে এতে আপনাকে ঘি দেব। গ্রাহক বলেন, ভাই আমার সময় নেই এটাতেই দিন কোনো সমস্যা নেই। বিক্রেতা বলেন, আপনার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। আমার ঘি যেই সেই পাত্রে সরবরাহ করি না। কারণ এতে ঘিয়ের মান যথাযথ থাকবে না, ফলে আমার ব্যবসার সুনাম নষ্ট হবে। এক সের ঘি বিক্রি করে আমার ব্যবসার সুনাম নষ্ট করতে চাই না।
আজকের যুগে হলে কী হতো? ভালোমন্দের দায় যেহেতু ক্রেতা নিচ্ছে আমার বিক্রি করতে দোষ কী? ঠিক এ কারণেই আমরা আজকে শুধু ঘি নয় দুধ মাখন পনির ছানা এমনকি ফলফলাদির প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত। শুধু খাবার-দাবারে নয় আমাদের চিন্তা-চেতনা, আমল-আখলাকের প্রচার-প্রসার অবিশুদ্ধ পাত্রের মাধ্যমে হচ্ছে বলে দেশে হাজার হাজার আলেম উলামা মসজিদ মাদ্রাসা খানকাহ দরবার থাকার পরও আসমানী এলেমের প্রকৃত ফায়দা থেকে বঞ্চিত। আহলে দিল কবি আল্লামা ইকবালের ভাষায় ‘রুসমে আজাঁ রাহ গিয়া রূহে বেলালী নাহ্ রাহী ফালসাফা রাহ্ গিয়া তালক্বীনে গাজালী নাহ্ রাহী (আজানের রুসুম আজো আছে বেলালের সেই আত্মা নেই/দর্শন শাস্ত্র আজো আছে গাজ্জালির সেই শিক্ষা নেই) তাই আমাদের আত্মা বিশুদ্ধ করতে হবে তবেই কাজে বরকত হবে।
এজন্য নিয়তের বিশুদ্ধতা জরুরি। হাদিসের ভাষায় ‘ইন্নামাল আ’মালু বিন্নিয়াত’-এ প্রত্যেক আমলের পরিপূর্ণতা এবং সাফল্য তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। নিয়ত বিশুদ্ধ হলে পাত্র বিশুদ্ধ হতে বাধ্য। যে বাবুর্চি তার তৈরি খাবার দিয়ে মানুষের সুস্বাস্থ্য ও সন্তুষ্টি কামনা করে, সে কখনও অপরিচ্ছন্ন পাত্রে খাবার তৈরি এবং পরিবেশন করে না। যার নিয়তে গরমিল আছে সে এগুলোর বাছবিচার করে না।
আগেকার দিনে দ্বীনি এলেম শিক্ষার জন্য শরাফতের (সম্ভ্রান্ত বংশ) সনদ লাগত। কলকাতা আলিয়া বা দারুল উলুম দেওবন্দে পড়তে গেলে ভর্তির সময়ে চারিত্রিক সনদ দেখানো লাগত। কারণ আলেমরা হলেন রূহানী চিকিৎসক। কারণ ভুল পাত্রে যদি এলেমের নেয়ামত ঢালা হয় সে এলেম থেকে সমাজে ফেৎনা তৈরি হবে। যার পরিণতি আজ আমরা দেখছি। কোনো রকম তাকমিল শেষ করে ইফতার একটি শর্ট কোর্স করে নামের আগে মুফতি যথায় তথায় ফতোয়া দিয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করছে। আমাদের উস্তাদের মুখে শুনেছি আগে কলকাতা আলিয়া বা দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে কোনো আহলে দিল আলেমের সোহবতে নির্দিষ্ট কিছুদিন সময় ব্যয় করে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতেন, ফলে সমাজে প্রেমের ফল্গুধারা বইয়ে চলত। এই দেশের তাবলিগি মুরব্বি খুলনার মাওলানা আজিজুল হক, সোনারগাঁ-এর মাওলানা লালপুরী শাহ, চট্টগ্রামের ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ। দ্বীনি এলেম বিকাশের রাহবর মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী সদর সাব হুজুর, পীরজি হুজুর, হাফেজ্জী হুজুর এদের জীবনের দিকে তাকালে এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখতে পাব। এসব মনিষী মোনাজাত করলে প্রেমের হাওয়া বইতে থাকত। দোয়াপ্রার্থীর দোয়া কবুল হতো।