ইসলাম ডেস্ক: পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। তার দয়া ও রহমতের কোনো তুলনা হয় না। তিনি বান্দার কোনো কোনো ছোট আমলেও অনেক বেশি সন্তুষ্ঠ হয়ে থাকেন। নেক আমল বাহ্যিকভাবে ছোট ও সহজ বলেই সে সম্পর্কে অবহেলা করা উচিত নয়।
হাদীস শরীফে এমন অনেক আমলের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা করতে সহজ, কিন্তু এর প্রাপ্তি বিশাল। তাই এসব আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি। সহীহ হাদীসের আলোকে এসব আমলের কিছুটা জেনে নিই-
১. বিশুদ্ধ নিয়ত
নিয়ত অর্থ সংকল্প। এটি মনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি আমল। এতে নেই কোনো কষ্ট-ক্লেশ, নেই কোনো মেহনত-মুজাহাদা। প্রত্যেক কাজে, তা দ্বীনী কাজ হোক কিংবা দুনিয়াবী, শুরুতেই নিয়তকে শুদ্ধ করা কর্তব্য। সকল কাজ মাওলার সন'ষ্টির জন্য করার সংকল্পই হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত। এই নিয়ত মুমিন বান্দার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সকল কাজকেই নেকির কাজে পরিণত করতে পারে।
হাদীস : হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যার নিয়ত সে করবে। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া লাভের জন্য কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত উক্ত বিষয়ের জন্যই হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছিল।-(সহীহ বুখারী হাদীস ১; সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯০৭)
ব্যাখ্যা : এটি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ একটি হাদীস। এখানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, প্রত্যেক আমলের সওয়াবের জন্য নিয়ত জরুরি। শুধু আমল নয়; বরং প্রত্যেক মানুষকে তার নিয়তের উপরই প্রতিদান দেওয়া হবে। বোঝানোর জন্য নবীজী হিজরতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আমলের কথা বলেছেন। একজন মুহাজির তার হিজরতের পূর্ণ প্রতিদান পায়। পক্ষান্তরে অন্য ব্যক্তি বাহ্যত একই আমল করার পরও বঞ্চিত হয়। এর নিগূঢ় রহস্য মাত্র তিন অক্ষরের নিয়ত শব্দের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্যের নিয়তে হিজরত করবে তার হিজরত হবে মকবুল ও প্রতিদানযোগ্য। আর সে পাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অশেষ সওয়াব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পার্থিব কোনো উপকার যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা প্রেয়সী নারীকে বিয়ে করার নিয়তে স্বজন ও স্বদেশ ত্যাগ করে বাহ্যত তা হিজরত হলেও তা হবে ব্যর্থ ও প্রতিদানের অযোগ্য। একই কষ্ট ও মুজাহাদা করার পরও মুহাজিরদের পুরষ্কার থেকে সে হবে বঞ্চিত।
ফায়েদা : এই হাদীস থেকে নিয়তের গুরুত্ব ও ফযীলত জানা গেল। উত্তম নিয়তের কারণে মানুষ আমলের সওয়াব পাবে পক্ষান্তরে নিয়তের ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার কারণে সে হবে প্রশ্নের মুখোমুখি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে একনিষ্ঠ মনে শাহাদাতের প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন। যদিও সে স্বীয় বিছানায় মৃত্যুবরণ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৯
আরেকটি হাদীসে তাবুক যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত সাহাবীদেরকে উদ্দেশ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই মদীনায় এমন কিছু মানুষ রয়েছে, (তাবুক পর্যন্ত) প্রতিটি পথে প্রান্তরে; প্রতিটি টিলা-টক্করে যারা তোমাদের সাথেই ছিল। তারাও তোমাদের মতো জিহাদের সওয়াব লাভ করবে। কারণ পূর্ণ নিয়ত থাকা সত্ত্বেও অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওযর তাদের জিহাদে অংশগ্রহণে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।-(সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯১১)
এই উভয় হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, শুধু নিয়তের আমলটির কারণে যে কোনো মহৎ ও ফযীলতপূর্ণ আমলের সওয়াব তাদের মতোই পাওয়া যাবে যারা কষ্ট-সাধনার মাধ্যমে নিজেরা এই আমলগুলি সম্পাদন করেছে। অথচ সে ব্যক্তি পূর্ণ ইখলাসের সাথে ঐ আমলের শুধু নিয়তই করেছিল। আর কিছুই করতে পারেনি। অতএব যে কোনো উত্তম ও কল্যাণমূলক কাজের জন্য ইখলাসের সাথে বেশি বেশি নিয়ত করা উচিত। সাথে সাথে বেঁচে থাকা উচিত ভ্রষ্ট নিয়ত এবং ভ্রান্ত লক্ষ্য মনে পোষণ করা থেকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন শহীদকে ডাকা হবে এবং তার উপর আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতগুলো একে একে স্মরণ করানো হবে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি এসব নেয়ামত ভোগ করেছিলে? সে স্বীকার করে নিবে। বলবে, হ্যাঁ, এসব নেয়ামত আমি ভোগ করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন, ওই সব নেয়ামতের শুকরিয়ায় তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি আপনার রাস্তায় লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ; তুমি তো এই জন্য লড়াই করেছ, যেন তোমাকে বীর উপাধি দেওয়া হয়। তা তো দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাআলার নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে আনা হবে, যে নিজে ইলম শিখেছে, কুরআন পড়েছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। তাকেও পূর্ববর্তী ব্যক্তির মতো আল্লাহ তাআলার নেয়ামতগুলো স্মরণ করানো হবে এবং সে তা স্বীকার করে নিবে। আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন করবেন, এর প্রতিদানে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, আমি তোমার জন্য ইলম শিখেছি, কুরআন পড়েছি এবং অপরকে শিখিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ; বরং তুমি তো এই জন্য ইলম শিখেছ যাতে লোকে তোমাকে আলেম বলে। তা তো বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তৃতীয় আরেক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে যে ছিল বিত্তশালী যাকে আল্লাহ তাআলা প্রচুর সম্পদ ও ঐশ্বর্য দান করেছিলেন। পূর্বোক্ত দুই ব্যক্তির মতো তাকেও আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে প্রশ্ন করা হবে যে, তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে, মাওলা! ব্যয়ের জন্য তোমার পছন্দনীয় এমন কোনো খাত বাদ যায়নি, যে খাতে তোমারই সন্তুষ্টির জন্য আমি দান করিনি। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। বরং তুমি তা করেছ শুধু এ জন্যই যাতে লোকেরা তোমাকে দানবীর উপাধি দেয়। তা তো দেওয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।-(সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯০৫)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, সৎ কাজ করার পরও শুধু নিয়ত বিশুদ্ধ না থাকায় কী নির্মম ও করুণ পরিণতি!