মো: আবদুল গনী শিব্বীর: পবিত্র কুরআন মাজিদের আয়াত ও হাদিসে রাসূল সা: পর্যালোচনা করে আমরা জানতে পারি, যেসব কাজে দেরি করতে নেই তার মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ তাগিত রয়েছে। এ নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. বিয়ে করা বা বিয়ে দেয়া : বিয়ে মহান আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত। রাসূল সা:-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। ঈমানের পূর্ণতার সহায়ক। চারিত্রিক আত্মরক্ষার অনুপম হাতিয়ার। যুবক-যুবতীর চরিত্র গঠনের অন্যতম উপাদান। আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিয়ে, যা প্রত্যেক মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। এ চাহিদা পূরণার্থেই ইসলামী শরিয়ত বিয়ের হুকুম আরোপ করেছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা রুম, আয়াত-২১)।
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা নারীদের মধ্য থেকে নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করো’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-২)। ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিয়েহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়ে করতে সমর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন’ (সূরা নূর, আয়াত : ৩২-৩৩)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা:-এর সাথে আমরা কতক যুবক ছিলাম; আর আমাদের কোনো কিছু ছিল না। এই হালতে আমাদের রাসূল সা: বলেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান হিফাজত করে এবং যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন সাওম পালন করে। কেননা, সাওম তার যৌনতাকে দমন করবে’ (সহিহ বুখারি-৪৬৯৬)। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে মেয়েদের বিয়ে করা হয়- তার সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার সৌন্দর্য ও তার দ্বীনদারি। সুতরাং তুমি দ্বীনদারিকেই প্রাধান্য দেবে নতুবা তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (সহিহ মুসলিম-১৪৬৬, সুনানে আহমাদ-৯৫২৬)।
হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, হজরত রাসূলে আকরাম সা: বলেন, ‘বিয়ে আমার সুন্নাত, যে আমার সুন্নাতের ওপর আমল করবে না সে আমার দলভুক্ত নয়। সুতরাং তোমরা বিয়ে করো’ (ইবনে মাজাহ-১৯১৯)। হজরত আনাস ইবনে মালিক রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বিয়ের জোরালো আদেশ দিতেন আর বিয়ে থেকে দূরে থাকাকে প্রচণ্ড নিষেধ করতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা অধিক সন্তান দানকারিণী নারীদের বিয়ে করো। কেননা, আমি কাল কিয়ামতের দিন অন্য নবীদের ওপর আমার উম্মতের বেশি সংখ্যা নিয়ে গর্ব করব’ (মুসনাদে আহমদ -১৩৫৬৯)।
২. তাওবা করা : তাওবা শব্দের আক্ষরিক অর্থ ফিরে আসা ও প্রত্যাবর্তন করা। পারিভাষিক অর্থে তাওবা হলো, শরিয়তবহির্ভূত নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করে ইসলাম নির্দেশিত কাজ করার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ফিরে আসা এবং আল্লাহর বিধানের ওপর অটল-অবিচল থাকা। তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয় ইবাদত। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। প্রতিনিয়ত তার কোনো না কোনো গোনাহ হয়ে থাকে। মানুষের পাহাড়সম গোনাহ হয়ে গেলেও ক্ষমা চাইলে আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেন। তার দোষত্রুটি গোপন রেখে তাকে করেন নিরাপদ। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি বেশি তাওবাকারীকে ভালোবাসেন’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২২২)। ‘আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি জুলুম করবে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (সূরা নিসা, আয়াত-১১০)।
এ তাওবা প্রসঙ্গে পবিত্র হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ইয়া আইয়ুহান নাসু তুবু ইলাল্লাহি’ অর্থাৎ হে মানবজাতি! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো। এর অর্থ হলো- আল্লাহর কাছে ফিরে এসো, প্রত্যাবর্তন করো’ (মুসলিম-৭০৩৪)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সে সত্ত্বার শপথ! যার হাতে আমার জীবন। যদি তোমরা গোনাহ না করো; তবে আল্লাহ তোমাদেরকে নিয়ে যাবেন এবং এমন এক সম্প্রদায় নিয়ে আসবেন, যারা গোনাহ করবে এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করবে। অতপর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন।’ (মুসলিম)।
উল্লেখ্য, তিনটি শর্ত বাস্তবায়ন করলেই তাওবা হয়ে যাবে। শর্ত তিনটি হলো- এক. পাপ পুরোপুরিভাবে ছেড়ে দিতে হবে। দুই. পাপের জন্য অনুশোচনা করতে হবে, লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে। তিন. ওই পাপ দ্বিতীয়বার না করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে, দৃঢ় সঙ্কল্প করতে হবে এবং এর ওপর অটল ও অবিচল থাকতে হবে।
৩. হজ পালন করা : হজ মহান আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের অন্যতম সেরা উপায়। সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মক্কা শরিফ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর আল্লাহর জন্য হজ আদায় করা ফরজ’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত-৯৭)। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরিক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্য। আর মানুষের মাঝে তুমি হজের ঘোষণা প্রচার করো, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, উটে চড়ে এবং সর্বপ্রকার বাহনে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে’ (সূরা হজ, আয়াত : ২৬-২৭)।
হজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, আমি নবী করিম সা:কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিবেদিতভাবে, সর্বপ্রকার পাপ, অন্যায় ও অশ্লীলতামুক্ত হয়ে হজ আদায় করল, সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরল।’ (বুখারি-১৫২১, মুসলিম-১৩৫০)। তিনি আরো বলেছেন; একবার ওমরাহ আদায়ের পরে দ্বিতীয়বার যখন ওমরাহ আদায় করা হয়, তখন দুই ওমরাহর মধ্যবর্তী গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। আর হজে মাবরুর বা পুণ্যময় হজের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত’ (বুখারি-১৭৭৩; মুসলিম-১৩৪৯; তিরমিজি-৯৩৩; নাসায়ি-২৬২৯; ইবনে মাজাহ-২৮৮৮)।
তাড়াতাড়ি হজ আদায় প্রসঙ্গে হজরত ইবনে আববাস রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যেকোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে’ (ইবনে মাজাহ-২৮৮৩, আবু দাউদ-১৭৩২)।
লেখক : প্রভাষক, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী।