ড. আবু সালেহ মুহাম্মাদ তোহা: সময় ফুরিয়ে যায়। দিন শেষে রাত আসে, রাত শেষে আবার দিন। বছর ফুরিয়ে আবার নতুন বছর শুরু হয়। এভাবে একসময় জীবন ফুরিয়ে যায়। জীবনকে কাজে লাগানোই সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। সময়ের ধারাবাহিকতায় আরো একটি বছর ফুরিয়ে নতুন আরেকটি বছরের অপেক্ষায় সারা বিশ্ব। আগের বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে অনেকের অনেক রকম প্রস্তুতি চলছে। তবে ঈমানি চেতনা ঈমানদারদের নতুন বছরের আগমন ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে অনুপ্রাণিত করে।
আল্লাহর নিদর্শন থেকে শিক্ষালাভ : সূর্য ও চন্দ্র মহান আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি ও অন্যতম নিদর্শন। বিশ্ব ব্যবস্থাপনা সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও কিরণ-রশ্মির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত রয়েছে। সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও নিজ কক্ষপথে বিচরণব্যবস্থা একটি বিশেষ হিসাব ও পরিমাপ অনুযায়ী চলছে। এর মাধ্যমেই রাত-দিনের পার্থক্য, ঋতুর পরিবর্তন এবং মাস-বছর নির্ধারিত হয়। সূর্যের গতি থেকে সৌরবর্ষ এবং চন্দ্রের গতি থেকে চন্দ্রবর্ষ হিসাব করা হয়। আকাশের চাঁদ দেখে চান্দ্রমাসের হিসাব সহজেই আয়ত্ত করা যায়। এ জন্য ইসলামী শরিয়ত চান্দ্রমাসের হিসাবকে গ্রহণ করেছে। সে হিসাবেই রোজা, হজ ইত্যাদি সম্পাদিত হয়। এসব নিদর্শন থেকে শিক্ষা লাভ করে আল্লাহমুখী হওয়াই ঈমানি চেতনার আবেদন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনজিল (কক্ষপথ) নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃিষ্ট করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫)
আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা : নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে জীবনের কল্যাণ-অকল্যাণ বা মঙ্গল-অমঙ্গলের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন বিশ্বাস করা শিরক, যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তবে মহান আল্লাহর কাছে নতুন বছরের জন্য ইহকালীন ও পরকালীন সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ কামনা করা যেতেই পারে। আল্লাহই বান্দার সুখ, শান্তি, সফলতা এবং কল্যাণ প্রদানকারী—অন্য কেউ নয়। কোরআনে এসেছে, ‘আমি কি তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে অন্যদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তাহলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হব।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ২৩-২৪)
মৃত্যুর স্মরণ ও পরকালের প্রস্তুতি : আল্লাহ তাআলা মানুষকে সুনির্দিষ্ট একটি সময়কাল দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এই সময়কালের কোনো হেরফের বা কমবেশি হয় না। যার জন্য যতটুকু সময় নির্ধারিত, ততটুকু ফুরিয়ে গেলেই জীবন শেষ হয়ে মৃত্যুর ডাক এসে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু যখন কারো নির্ধারিত সময়কাল উপস্থিত হবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কিছুই করো আল্লাহ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা : মুনাফিকুন, আয়াত : ১১)
এক একটি বছরের আগমন মানুষকে তার নির্ধারিত মৃত্যুর কাছাকাছি করে দেয়। কাজেই নতুন বছরের সূচনায় মৃত্যুকে স্মরণ করে পরকালীন জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করাই ঈমানের দাবি।
জীবনের হিসাব : নতুন বছর আগমন কালে বিগত বছরের পর্যালোচনা ও নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। কাজেই অতীতের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে এবং পাপের জন্য মহান আল্লাহর কাছে তাওবা করে নতুন বছরে নির্ভুল এবং পাপমুক্ত জীবন কাটানোর জন্য প্রত্যয়ী হতে হবে। পরকালে আল্লাহর সামনে হিসাব-নিকাশের মুখোমুখি হওয়ার আগে পৃথিবীতেই জীবনের হিসাব-নিকাশ করে নিতে হবে। উমর (রা.) বলতেন, ‘তোমরা তোমাদের নিজেদের হিসাব করে নাও, তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৯)
বিজাতীয় সংস্কৃতি পরিহার : নতুন বছরকে আনুষ্ঠানিক স্বাগত জানানো বা বিগত বছরকে বিদায় জানানোর সঙ্গে ইসলামের ইবাদত-বন্দেগি, রীতি-নীতি বা সভ্যতা-সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ পালন বা এজাতীয় আচার-অনুষ্ঠান বিজাতীয় সংস্কৃতির অংশ, যা মুসলমানদের জন্য অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত বিবেচিত হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৩৩)
অশ্লীলতা পরিহার : ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ পালনে নানাবিধ অশ্লীলতা, নগ্নতা, মদ্য পান, তরুণ-তরুণীর যৌন-উন্মাদনাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংবাদ পাওয়া যায়, যেগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অপরাধ। ইসলামে কোনো ধরনের অনৈতিক ও অনর্থক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কর্ম ও সীমা লঙ্ঘন; তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
পরিশেষে বলা যায়, বর্ষবরণ বা বিদায়ের নামে অশ্লীল ও অনর্থক কর্মকাণ্ড পরিহার করে জীবনের সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই জীবনকে মূল্যায়ন করতে হবে। জীবন ভাবনায় স্মরণ করতে হবে যে এক-একটি বছরের আগমন জীবনকে আরো সংকীর্ণ করছে এবং মৃত্যুকে নিকটবর্তী করছে। কাজেই বিগত বছরের পর্যালোচনা এবং নতুন বছরের ঈমানবান্ধব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মধ্যেই নববর্ষের সার্থকতা।