মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২১, ১১:২১:৩৭

শীতের তীব্রতা জাহান্নামের শীতলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

শীতের তীব্রতা জাহান্নামের শীতলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়

ড. আবু সালেহ মুহাম্মাদ তোহা: সময়ের পরিবর্তনে বছর ঘুরে শীতের আগমন ঘটে। একসময় শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। তীব্র শীতে একটু কষ্ট করেই ওজু করতে হয়। কুয়াশা ভেদ করে রাতের নামাজের জন্য মসজিদে যেতে হয়। বাড়তি কষ্টের বিনিময়ে মহান আল্লাহ আমলের নেকির মাত্রাও বাড়িয়ে দেন। সেই সঙ্গে শীতে হরেক রকম শাক-সবজি উৎপাদন হয়। খেজুরগাছ থেকে মিষ্টি রস পাওয়া যায়। নানা রকম পিঠা-পুলির আয়োজন হয়। সব মিলিয়ে শীতকাল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অনন্য নিয়ামত হিসেবে বান্দার কাছে হাজির হয়।

শীতের তীব্রতার রহস্য : শীত-গ্রীষ্ম সবই মহান আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টির বিচিত্র রূপ। রাত-দিনের পরিবর্তন, ঋতুবৈচিত্র্য এবং সৃষ্টির অনুপম নৈপুণ্যতা সবই মহান আল্লাহর মহিমা। ঋতুর পরিবর্তনে শীত ও গ্রীষ্ম আসে। একসময় তীব্র শীত আবার একসময় তীব্র গরম অনুভূত হয়। শীত ও গ্রীষ্মের তীব্রতা আসে জাহান্নামের নিঃশ্বাস থেকে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের কাছে অভিযোগ করে বলে, হে প্রতিপালক, আমার এক অংশ অপর অংশকে খেয়ে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তাকে দুটি নিঃশ্বাস ফেলার অনুমতি প্রদান করেন। একটি নিঃশ্বাস শীতকালে, আর একটি গ্রীষ্মকালে। কাজেই তোমরা গরমের তীব্রতা এবং শীতের তীব্রতা পেয়ে থাকো।’ (বুখারি, হাদিস : ৩০৮৭)

জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা : শীতের তীব্রতা জাহান্নামের শীতলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজেই তীব্র শীতে জাহান্নামের কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করা উচিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো বান্দা তীব্র শীতের সময় বলে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই), আজকের দিনটি কতই না শীতল। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে জামহারির জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন। তখন আল্লাহ জাহান্নামকে লক্ষ্য করে বলেন, আমার এক বান্দা তোমার জাহান্নাম থেকে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। আমি তোমাকে সাক্ষ্য রেখে বলছি, আমি তাকে মুক্তি দিলাম।’ সাহাবিরা বলেন, জামহারির কী? জবাবে রাসুল (সা.) বললেন, ‘জামহারির জাহান্নামের এমন একটি ঘর, যেখানে কাফিরদের নিক্ষেপ করা হবে। শীতের তীব্রতায় তারা বিবর্ণ হয়ে যাবে।’ (আস-সিলসিলাতুদ-দায়িফাহ, হাদিস : ৬৪২৮)

শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ার দৃষ্টান্ত : শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পড়ে। শীতের শেষ দিকে গাছপালার সব পত্র-পল্লব শূন্য হয়ে যায়। গুরুত্বসহকারে নামাজ আদায় করলে নামাজির পাপগুলোও এভাবে ঝরে যায়। আবু জার গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) শীতকালের কোনো একদিন বের হলেন, যখন গাছের পত্র-পল্লব ঝরে পড়ছিল। তিনি গাছের দুটি ডাল ধরলেন, ফলে পাতাগুলো আরো বেশি ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, ‘হে আবু জার,’ আমি বললাম, আমি উপস্থিত, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, ‘কোনো মুসলমান বান্দা যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করে, তখন তার পাপগুলো এই গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২১৫৯৬)

শীতকাল ইবাদতের বসন্তকাল : শীতকাল মুমিনের জন্য অনন্য আশীর্বাদ। অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এ মৌসুমে অনেক বেশি ইবাদত করা যায়। রাত লম্বা হওয়ায় অনেক সময় ধরে রাতে নামাজ আদায় করা যায়। আবার দিন ছোট ও আরামদায়ক হওয়ায় সহজে রোজা পালন করা যায়। এ জন্যই হাদিসে শীতকালকে মুমিনের বসন্তকাল বলা হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শীতকাল মুমিনের বসন্তকাল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১৭৩৪)

শীতকালের রোজা : রোজা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নেকি লাভের অন্যতম মাধ্যম। শীতকালের রোজায় স্বল্প সময় ব্যয় হয়। সুতরাং শীতকাল রোজা পালনের মোক্ষম সুযোগ। এ জন্য শীতকালের রোজাকে বিনা পরিশ্রমে নেকি লাভের মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমির ইবনে মাসউদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘শীতকালের রোজা হচ্ছে বিনা পরিশ্রমে যুদ্ধলব্ধ মালের অনুরূপ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৭)

শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো : শীত নিবারণের মতো পোশাক-পরিচ্ছদ সব মানুষের থাকে না। খাদ্য-পুষ্টি ও বাসস্থানের অভাবে অনেকেই শীতে মানবেতর জীবন-যাপন করে। সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুমিন যদি অন্য কোনো মুমিনের ক্ষুধায় অন্ন জোগায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল আহার করাবেন। কোনো মুমিন যদি অন্য কোনো মুমিনের পিপাসায় পানি পান করায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সিল করা জান্নাতি পানীয় পান করাবেন। কোনো মুমিন যদি অন্য কোনো বস্ত্রহীন মুমিনকে পরিধান করায়, তাহলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরিধান করাবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪৪৯)

শীতে কষ্ট সত্ত্বেও ওজু করা : শীতকালে সব কিছু শীতল হয়ে থাকে। পানি তো বরফের মতো হয়ে যায়। কাজেই ওজু করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে এশা ও ফজরের নামাজের জন্য ওজু করা খুবই কষ্টকর হয়। শীতের তীব্রতায় কষ্টের কারণে আল্লাহ তায়ালা নেকির মাত্রাও বাড়িয়ে দেন। শীতে পরিপূর্ণভাবে ওজু করা অনেক নেকির কাজ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন কিছু শিখিয়ে দেব না, যার কারণে আল্লাহ পাপ মোচন করবেন এবং জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন? সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, মন না চাইলেও ভালোভাবে অজু করা, অধিক পদক্ষেপে মসজিদে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬১০)

পরিশেষে বলা যায়, শীতকালে নতুন কিছু ইবাদত করার সুযোগ তৈরি হয়,  কিছু ইবাদত পালন করা সহজ হয় এবং কিছু ইবাদতে কষ্ট বৃদ্ধির কারণে নেকির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। কাজেই শীতকালকে বিরক্তিকর বা অসহনীয় মনে না করে; বরং ইবাদত করে নেকির পাল্লা ভারী করার চেষ্টা অব্যাহত রাখাই ঈমানের পরিচয়।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে