এহসান সিরাজ : ‘প্রথম হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় জাতীয় পুরস্কার পাই সেই শৈশবে, ১০ বছর বয়সে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে; আরেকটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে। সেটি ১৯৮৬ সালের কথা। তারপর ১৯৯০ সালে যেতে চাই আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায়। কিন্তু বয়স স্বল্পতার কারণে তার অনুমতি মেলেনি।’
কথাগুলো বলছিলেন হাফেজা কারিয়া শামসুন্নাহার সিদ্দিকা। অনুমতি পাননি বলে থেমে যাননি। তার বাবা মাওলানা শরাফত উল্লাহ খুব করে চাইতেন, মেয়ে তার আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক।
বিয়ের পর তাকে আরেকটু এগিয়ে দিলেন তার স্বামী ডাক্তার মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম। প্রিয়তম স্বামীর উৎসাহে শামসুন্নাহারের স্বপ্নের ঘোড়া তখন আরও তেজস্বী হয়ে ওঠে। দেশের সীমানা পেরিয়ে তিনি তখন ডানা মেলেন বিদেশের মাটিতে।
মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৭ বার তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ২০০৪ সাল থেকে টানা ২০০৯ সাল পর্যন্ত। সর্বশেষ ২০১৬ সালে। এর আগে ১৯৯৮ সালে হয়েছিলেন দ্বিতীয়। ইরানেও গিয়েছেন একবার।
শামসুন্নাহারের চার মেয়ে। জানতে চাইলাম, সন্তান সামলে কীভাবে এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন?
তিনি বললেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আমি আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব। বিয়ের পর কেউ স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। আমার শাশুড়ি, আমার বোন অনেক সময় আমার সন্তান সামলিয়েছেন। তবে যারা প্রতিযোগী থাকত বাংলাদেশের, তারা আমাকে আটকানোর চেষ্টা করেছে বহুবার! প্রতি বছরই যখন মালয়েশিয়া যাচ্ছি, কর্তৃপক্ষের মনে খটকা লাগল। তখন বিশ-ত্রিশজন বিচারক একসঙ্গে বসে আমার পরীক্ষা নিলেন। তাদের মধ্যে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের মরহুম খতিব উবায়দুল হকও ছিলেন। আমার তিলাওয়াত শুনে তারা বললেন, ‘আসলেই তুমি যোগ্য।’
শামসুন্নাহারের চার মেয়ে। মেয়েদের সবাইকে তিনি নিজেই হাফেজা বানিয়েছেন। তারা হলেন- হাফেজা ফাতিমাতুজ জুহরা মারিয়া, হাফেজা কারিয়া খাদিজাতুল কুবরা উলফাত, হাফেজা কারিয়া আয়েশা সিদ্দিকা, হাফেজা ফাবিহা বুশরা আরাবিয়া।
বিশ্বজয়ী হাফেজা শামসুন্নাহার বলেন, ‘শেরপুর থেকে ঢাকায় এসে তেজগাঁও রহমতে আলম মিশন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করি। মূলত এখানে হেফজ শুনাই। পাশাপাশি অন্যদের মশকও করাতাম। বিয়ের পর কিছুদিন এখানে শিক্ষকতা করেছি। তারপর চলে এসে নিজে একটি মাদ্রাসা দিই। মাদ্রাসার বয়স ২৭ বছর। আমার চার মেয়ে আমার কাছেই হাফেজ হয়েছে।’
মা যেমন বিশ্বজয়ী হাফেজা, তেমনি ঠিক তার মেয়েরাও। মেয়েরা তার কাছে হাফেজ হয়ে তাজবিদ ও লেহান (স্বর ও সুর) শেখার জন্য পড়াশোনা করছেন মারকাযুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায়।
তিনি বললেন, ‘সাধারণত মহিলা মাদ্রাসায় তাজবিদের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু হাফেজ নেসার সাহেবের মাদ্রাসায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই মেয়েদের সেখানে পাঠিয়েছি। আমার মেয়ে আয়েশা পাঁচ বছর বয়সে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে জাতীয় পুরস্কার পায়। আমার বাবা আমাকে বলেন, ‘তুমি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছ ১০ বছর বয়সে, আর তোমার মেয়ে পেয়েছে পাঁচ বছর বয়সে।’
হাফেজা আয়েশা সিদ্দিকা ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় যেতে চেয়েছিল। বয়স স্বল্পতার অজুহাতে অনুমতি মেলেনি। ২০১৮ সালে বয়স পার হলেও পাসপোর্ট জটিলতায় তার ইরান যাওয়া অনেকটাই আটকে যায়। অবশ্য বহু কাঠখড় পড়ানোর পর যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার। ইরান থেকে নিয়ে এসেছিলেন চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু করোনার প্রকোপে আর যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তার বড় বোন খাদিজাতুল কুবরা ২০২০ সালে ইরান আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। করোনার প্রকোপে তাও থমকে গেছে।
খাদিজাতুল কুবরা বলেন, ‘কুরআন তিলাওয়াত আমার নেশা হয়ে গেছে। দৈনিক পাঁচ পারা কাউকে না শুনালে আমার ভালোই লাগে না।’
আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘রমজানে এখন নামাজে বেশি তিলাওয়াত করি। প্রতিদিন জোহর নামাজে যে দুই পারা তিলাওয়াত করি, সেই দুই পারা আসর, মাগরিব, এশা ও তাহাজ্জুদেও তেলাওয়াত করি। ফলে একদিনে এই দুই পারা পাঁচবার তিলাওয়াত হয়। পুরো রমজানে নামাজেই হবে ১০ খতম।’
এমন গুণী মেয়েদের পেয়ে গর্বিত কিনা জানতে চাইলে হাফেজা শামসুন্নাহার বলেন, ‘হাফেজদের মায়েদের জন্য আখেরাতে রয়েছে জান্নাত। কিন্তু আমার মেয়েদের দিকে তাকালে, তাদের তিলাওয়াত শুনলে মনে হয়, আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতেই জান্নাত দিয়ে দিয়েছেন। আমি চাই, তারা হিফজ অটুট রাখুক। দ্বীনের পথে চলুক। কুরআনের আলো ছড়িয়ে দিক দিগ্বিদিক। যেন আখেরাতে কোথাও আটকাতে না হয়।’
লেখক : তরুণ আলেম, সমাজকর্মী ও ধর্মীয় নিবন্ধকার