ইসলামিক ডেস্ক: আজ ১৭ রমজান। সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ের দিন। এদিন মুসলমানদের সাথে কাফেরদের প্রথম যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। যা ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। ঘুমিয়ে পড়া জীর্ণশীর্ণ মুসলমানকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য বদরের চেতনার চেয়ে কার্যকরী আর কিছুই হতে পারে না। বদর মুসলমানের ঈমানি চেতনাকে শাণিত করে।
মাত্র দুই বছর আগে মক্কায় কাফেরদের অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে নবীজী সাহাবিদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় নবীজীর সুখ্যাতি ও চার দিকে ইসলামের সুমহান বার্তা কাফেরদের মনকে ভীষণ বিষিয়ে তুলেছিল। নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত থেমে থাকেনি। ভারি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের জন্য তারা আবু সুফিয়ানকে শামে পাঠায়। মুসলমানরা এই খবর জানতে পেরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফেরার পথে আবু সুফিয়ানের পথ আগলে দাঁড়ায়। মুসলমানদের উদ্দেশ্য ছিল তার থেকে যুদ্ধের সরঞ্জাম কেড়ে নেয়া। এদিকে মক্কায় অপপ্রচার রটে যে, মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের ওপর হামলা করেছে। আবু জাহেলের নেতৃত্বে ১০০০ সৈন্যে নিয়ে কাফেরদের বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণে বের হয়ে পড়ে। মুসলমানরা আক্রমণ প্রতিহত করতে বদরের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়।
দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১৭ তারিখ। রোজা রেখে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত নবীজীর কাফেলা। বদরের মাঠে কাফের বাহিনীর এক হাজার সশস্ত্র সৈন্য বাহিনীর মুখোমুখি মাত্র ৩১৩ জন মর্দে-মুজাহিদ। জাগতিক দৃষ্টিতে দেখলে যে কেউই যুদ্ধের আগে মুমিন বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয়ের কথা বলে দিতে পারবে। কিন্তু এ বাহিনী তো জাগতিক দৃষ্টির বাইরেও আরেকটি দৃষ্টি অর্জন করেছিল। তা হলো ঈমানি দৃষ্টি। জাগতিক অস্ত্র ছাড়াও ঈমানি অস্ত্র তাদের কলবের খাপে মোড়া ছিল। যুদ্ধের প্রস্তুতিকলে নবীজী সবার সাথে পরামর্শ করলেন। মুহাজিরগণ সর্বোচ্চ সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। নবীজীর মন ভরেনি। তিনি আবারো সমর্থন চাইলেন। এবার তিনি জানতে চাচ্ছেন মূলত আনসারদের মতামত।
কারণ আনসাররা মদিনার অধিবাসী। মদিনার অলিগলি সম্পর্কে অন্যদের চাইতে তাদের ধারণা বেশি। এই যুদ্ধে তাদের মতামত ও অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আনসার সাহাবি সাদ ইবনে মুয়াজ রা: বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:। আপনি আমাদের কাছে যা চান আমরা দিতে প্রস্তুত। আমাদের সাথে নিয়ে যেখানে যেতে চান আমরা না বলব না। আপনি যা আদেশ করবেন তাই আমরা মেনে নেবো। আরেক সাহাবি বললেন, আমরা মুসা আ:-এর উম্মতের মতো বলব না যে, আপনি আর আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন। বরং আমরা বলব, আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। আমরা আপনার চতুর্দিক থেকে দুর্গ গড়ে তুলব। নবীজীর আদেশ পেয়ে সাহাবারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, খেজুর গাছের শুকনো ঢাল হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে চকচকে তরবারিধারীদের ওপর। বুখারি শরিফের কিতাবুল মাগাজিতে এসেছে, যেসব সাহাবি শুকনো খেজুরের ঢাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, একসময় তারা দেখে খেজুরের ঢাল আর খেজুরের ঢাল নেই। চকচকে তরবারি বনে গেছে। সুবহানাল্লাহ। জাগতিক অস্ত্রের মোকাবেলায় ঈমানি অস্ত্র এমনই হয়।
আরেকটি ঘটনা, নবীজী সা: সৈনদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আবেগময়ী ভাষণ দিচ্ছেন। একপর্যায়ে বলছেন, ওই জান্নাতের দিকে ছুটে আসো যা আসমান ও জমিনের চেয়েও বড়। ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করে শহীদ হলে এমন ১০টি পৃথিবীর সমান একটি জান্নাত তোমাকে দেয়া হবে। পাশেই একজন সাহাবি খেজুর খাচ্ছিলেন। যখন জান্নাতের কথা শুনলেন, তখন বললেন, বাহ! কী চমৎকার জান্নাত বানিয়ে রেখেছেন আল্লাহ তায়ালা। আমি যদি হাতে থাকা খেজুরগুলো খেতে থাকি তাহলে তো জান্নাতে যেতে খুব দেরি হয়ে যাবে। এই বলে হাতের সব খেজুর ছুড়ে ফেলে সে চলে যায় জিহাদের ময়দানে। জগতের মানুষ ভরসা করে জাগতিক উপকরণের ওপর। মুমিন ভরসা করে আল্লাহর ওপর। তাইতো রাসূল সা: যুদ্ধ শুরুর আগে আগে আকাশের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহ! এত বিশাল সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার শক্তি এ ছোট্ট মুমিন বাহিনীর নেই। আজ যদি এ মুমিন বাহিনী হেরে যায়, তাহলে তোমাকে আল্লাহ বলে ডাকার আর কেউই থাকবে না। এভাবে দোয়া করে রাসূল সা: ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। আল্লাহর সাহায্য নাজিল হলো। বিশ্বাসীরা জয়ী হলো। এই যে অস্ত্রের বলে নয় দোয়া ও আল্লাহর উপর ভরসা রেখে প্রচেষ্টা করার ফলে বিজয় লাভ- এটাই বদরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আফসোস! আজ মুসলমানের সব আছে, শুধু ঈমানী শক্তিতে তারা হয়ে পড়েছে জীর্ণশীর্ণ।