মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘দ্য রিপাবলিক অব স্লোভেনিয়া’। এর পশ্চিমে রয়েছে ইতালি, উত্তরে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আড্রিয়াটিক সাগর। স্লোভেনিয়া পাহাড় ও বনসমৃদ্ধ দেশ। মোট আয়তন ২০ হাজার সাত শ একাত্তর বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২.১ মিলিয়ন। তাদের বেশির ভাগ স্লোভেনিজ জাতিভুক্ত। স্লোভেনিয়ার আবহাওয়া প্রধানত উপমহাদেশীয়।
লুবলিয়ানা দেশটির রাজধানী ও সর্ববৃহৎ শহর। ২০০২ সালে জরিপ মতে স্লোভেনিয়া মুসলমানের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৮২৪, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ২.৪ ভাগ। ২০১১ সালের জরিপের (অনানুষ্ঠানিক) তথ্যানুসারে মুসলমানের সংখ্যা ৪.৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আলজাজিরার তথ্যমতে, বর্তমানে দেশটিতে মুসলমানের সংখ্যা ৮০ হাজারেরও বেশি। স্লোভেনিজ মুসলিমদের বেশির ভাগ বসনিক ও আলবেনিয়ান।
ধারণা করা হয়, স্লোভেনিয়ায় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মানববসতি গড়ে ওঠে। লুবলিয়ানায় খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে চার হাজার বছর আগের ‘কাঠের চাকা’ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কাঠের চাকাগুলোর মধ্যে এটিই সর্বপ্রাচীন। মধ্য ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস অস্থিতিশীল। নানা সময়ে দেশটি রোমান, বাইজেন্টাইন, ক্যারোলিজিয়ান, হোলি রোমান, হাঙ্গেরি, ভেনিস, অস্ট্রিয়ান, উসমানীয় প্রভৃতি সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছে। অবশেষে ২৫ জুন ১৯৯১ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি।
খ্রিস্টীয় ১৫ থেকে ১৭ শতকের মধ্যে স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীন হয়। মূলত স্লোভেনিয়া হামবার্গ-উসমানীয়দের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় স্লোভেনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে খণ্ডকালীন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে স্লোভেনিয়ায় কখনো মুসলিম শাসন কখনো স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছেনি। তাই সেখানে মুসলিম নিদর্শনগুলোর মধ্যে সামরিক স্থাপত্যের আধিক্য দেখা যায়। বলকান অঞ্চলে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে; বিশেষত কসোভো, বসনিয়া, আলবেনিয়া, সাইপ্রাস ও তুরস্ক থেকে মুসলিমরা স্লোভেনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। ইউরোপে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অগযাত্রা থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোভেনিয়ায় ইসলাম ধর্মের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।
১৯১৫ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য বসনিয়ান মুসলিমদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে। এসব মুসলিম সেনারা স্লোভেনিয়ার ‘লগ পট ম্যানগার্টম’ শহরে মসজিদ নির্মাণ করে। এটাই ছিল স্লোভেনিয়ার একমাত্র রাষ্ট্র স্বীকৃত মসজিদ। ১৯২০ সালে মুসলিম সেনারা বসনিয়ায় ফিরে গেলে মসজিদটি পরিত্যক্ত হয়। ১৯৫০ সালের পর প্রতিবেশি মুসলিম দেশগুলোতে বহুসংখ্যক মুসলিম স্লোভেনিয়ায় ভাগ্যান্বেষণে এলে দেশটিতে মুসলিমদের ধর্মীয় তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬০ সালে দেশটিতে ‘দ্য ইসলামিক কমিউনিটি’ (আইসি) প্রতিষ্ঠিত হয়।
যদিও যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে মুসলিমরা খুব সামান্যই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করত। সে সময় প্রকাশ্যে ধর্মীয় আলোচনা নিষিদ্ধ ছিল, নারীদের হিজাব পরিধানে বাধা দেওয়া হতো, মসজিদগুলো বন্ধ করে তা গুদামঘর ও কারখানায় রূপান্তর করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হলেও স্লোভেনিয়ার মুসলিমদের নানা ধরনের বিধি-নিষেধের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। গবেষক ভেরোনিকা বাজ তার ‘মুসলিমস ইন স্লোভেনিয়া : বিটুইন টোলারেন্স অ্যান্ড ডিস্ক্রিমিনেশন’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে স্লোভেনিয়ান মুসলিমদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার নানা চিত্র তুলে ধরেছেন।
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৯১ সালের সংবিধান জনগণের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দেয়। ২০০৭ সালে স্লোভেনিয়ার পঞ্চম ধর্ম হিসেবে ইসলাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে। রাজধানী লুবলিয়ানায় একটি মসজিদ নির্মাণের আবেদন করার ৪৪ বছর পর ২০১৩ সালে স্লোভেনিয়ান সরকার তার অনুমোদন দেয়। ২০১৬ সালে মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে তা ২০২০ সালে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়। মসজিদ নির্মাণে ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়, যার ৭০ শতাংশ কাতার সরকার প্রদান করে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আলেনকা ব্রুতেসেক বলেন, ‘ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে এই ভবন হবে একটি প্রতীকী জয় এবং ইসলাম ছাড়া ইউরোপ কখনো সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে না।’
সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গঠিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্লোভেনিয়াই সর্বশেষ মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়। ‘দ্য ইসলামিক সেন্টার অব লুবলিয়ানা’ নামে পরিচিত এ মসজিদে ১৪০০ মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদের পাশাপাশি এখানে গড়ে তোলা হয়েছে কমিউনিটি অফিস, শিক্ষাকেন্দ্র, পাঠাগার, রেস্টুরেন্ট ও ইমাম-আলেমদের জন্য আবাসনকেন্দ্র। আশার কথা হলো, স্লোভেনিয়া মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন দ্রুত বাড়ছে। পিউ রিসার্চের তথ্যানুসারে স্লোভেনিয়ায় মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ২০৫০ সালে তা মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ ভাগে উন্নীত হবে, ইনশাআল্লাহ। তথ্যসূত্র : সিস্টারস ম্যাগাজিন, আলজাজিরা স্টাডিজ, উইকিপিডিয়া