শিশুটি তখন মায়ের গর্ভে। আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে দেখে ডাক্তার বলেন, অনাগত শিশু 'ডাউন সিনড্রোম' নিয়ে জন্মাবে, বিকলাঙ্গ হওয়ার সম্ভবনা প্রকট! মা শাকিলা তখন আল্লার কাছে দোয়া করেন মেয়েটি যেন সুস্থ হয়ে জন্মায়। মনে মনে নিয়ত করেন মেয়েকে কুরআনের হাফেজা বানাবেন ইসলামের জন্য তাকে নিবেদিত করবেন। সৃষ্টিকর্তা বড়ই রহম, তিনি দয়ালু! মায়ের দোয়া বৃথা যেতে দেননা!, তাইতো কবুল করে নিলেন সে দোয়া। ডাক্তারদের সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে বাস্তবে যে শিশুটি পৃথিবীতে এসেছিল, সে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক।
শিশুটির নাম রাখা হলো মারইয়াম মাসুদ। মা শাকিলা তার নিয়ত মতেই মেয়েকে কুরআনের হাফেজা বানালেন। মারইয়াম শুধু ত্রিশ পারা কোরআন শরিফ মুখস্থ করেনি, এখন সে সারা পৃথিবীর মুসলিম তরুণ সমাজের আইকন। সারাবিশ্বে লাখো শিশু-কিশোর মারইয়ামের কুরআনের ক্লাস দেখছেন ফেসবুক ও ইউটিউবে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা একটি শিশু মাত্র নয় বছর বয়সে কোরআনে হাফেজা হয়েছে। মাত্র তিন বছর বয়স যখন, তখনই ওর সুরেলা কণ্ঠের কোরআন পাঠ বিস্মিত ও মুগ্ধ করত সবাইকে। সাত থেকে নয়, দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে মারইয়াম ত্রিশ পারা পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেছে।
মারইয়ামের বর্তমান বয়স চৌদ্দ ছুঁই ছুঁই পড়ছেন অষ্টম শ্রেণিতে। বাবা-মা আর তিন বোনের সঙ্গে সে বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির সমারসেটে। বাবা–মা দুজনেই বাংলাদেশি নাগরিক। বাবা মাসুদুর রহমানের বাড়ি বগুড়া আর মা শাকিলার বাড়ি দিনাজপুরে। বাবা মাসুদুর রহমান পেশায় একজন সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট। বাবা মা বাঙালি হলেও মারইয়ামের জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা আমেরিকায়।
পবিত্র কোরআনের হাফেজা হতে পেরে নিজেকে সুভাগ্যবান মনে করেন মারইয়াম এ জন্য ধন্যবাদ জানায় আল্লাহ তায়ালাকে। অবাক ব্যাপার হল, মারিয়াম কোন নির্দিষ্ট হিফজের স্কুলে কখনো ভর্তি হয়নি। মায়ের মুখে শুনে কোরআন মুখস্থ করেছে সে। মা শাকিলা মেয়েকে শেখানোর প্রস্তুতি হিসেবে তাজবিদ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে অধ্যয়ন করেছেন। এখনো তিনি আল মাগরিব ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন করছেন।’ মেয়েকে কোরআন মুখস্থ করানোর জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে তাকে। কারণ মাঝে মাঝে শিশু কন্যার মতো মনে হতো, এত লম্বা সুরা মুখস্থ রাখা খুব কঠিন। অনেক সময় সে বলত, আর পারবে না সে। তখন মারইয়ামের মা বলতেন, ‘চল একটা প্রতিযোগিতা করি। কে কত তাড়াতাড়ি এই পৃষ্ঠা মুখস্থ করতে পারি, যে পারবে সে–ই জয়ী হবে।’ এভাবে মা আর মেয়ের প্রতিযোগিতা চলত। কখনো মেয়ে বাড়িতে খেলা করছে, মা ঘরের কাজ করছেন। কাজ করতে করতেই মা তার মুখস্থ সুরাগুলো পাঠ করতেন, মেয়ে শুনে শুনে মুখস্থ করত। স্কুলে যাওয়ার সময় গাড়ির সিডিতে সুরা দেওয়া হতো। মারিয়াম কখনো মুখস্থ করত, কখনো মুখস্থ করা সুরাটা আবার ঠিক আছে কিনা দেখত। স্কুল থেকে আসার পথে একই কাজ করত সে। এভাবেই কাজটা সহজ হয়ে যায়। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে কোরআন চর্চা ও ইউটিউবে নিজের চ্যানেলে সময় দেয় মারইয়াম? বিষয়টা সহজ নয়। কিন্তু সে এই কাজটিকে সহজ করে নিয়েছে। বাসায় ফিরে প্রথমেই সে সব হোম ওয়ার্ক শেষ করে ফেলে। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এরপরে মাগরিবের নামাজ শেষ করে পবিত্র কোরআন নিয়ে বসে। মারইয়াম মনে করে, কোন কিছু পরিকল্পনার সঙ্গে নিয়মিত করতে থাকলে ফল পাওয়া যায়।
মারইয়ামের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব মিলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মারইয়াম প্রতিনিয়ত তার ফেসবুক ও ইউটিউবে সুললিত কণ্ঠে কুরআনের উপর বিভিন্ন টিউটোরিয়াল আপলোড দিচ্ছেন পাশাপাশি ইসলামিক নাশীদও আপলোড করেছেন। এতে লাখ লাখ শিশু কিশোর কুরআন শিখছেন। কুরআনের মাঝে নিজেদেরকে সপে দিচ্ছেন। এতে দিন দিন ইউটিউবে তার ভিডিও দেখতে ভিড় করছেন তরুণ তরুণীরা।
মারইয়াম এখন গাইড ইউএস টিভিতে ‘কোরআন উইথ মারইয়াম’ শীর্ষক শিশুদের একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছে। মারইয়াম নিউজার্সির গভর্নর ফিল মারফির একটি প্রচার কাজে সাহায্য করছে। ‘ইন্টারফেইথ হিউম্যানেটারিয়ান’ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত সে। বছরখানিক আগে একটি ইন্টারফেইথ ইভেন্টে অতিথি বক্তা হিসেবে অংশ নেয় মারইয়াম, যেখানে সিনেটর বব মেনেনডেজ ও কংগ্রেসম্যান ফ্রাঙ্ক পেলোনসহ বহু প্রভাবশালী ও বিখ্যাত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ানফোরকিডস এবং মালয়েশিয়ান চ্যানেলে ‘ওমর’ ও ‘হানা শো’তে কাজ করে মারইয়াম। বিশ্বজুড়ে পিতৃমাতৃহীন শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইসলামিক রিলিফ ইউএসএর সম্মানিত দূত সে। সম্প্রতি সে সিরিয়া ও ইয়েমেনের এতিম শিশুদের জন্য পনের হাজার ডলার সংগ্রহ করেছে, যা বাংলাদেশি টাকায় একুশ লাখ। বিশ্বকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন মারইয়াম।
ভয়েজ অব আমেরিকার এক সাক্ষাৎকারে মারইয়াম বলেন, ভবিষ্যতে ইসলামিক স্কলার হতে চান। যাতে আগামী প্রজন্ম পবিত্র কোরআন পড়তে ও তার বাণীর সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারে। ইসলামকে নিজেদের জীবনে মননশীল করতে পারে।
মারইয়াম বহুমাত্রিক কাজের জন্য মুসলিম বিভিন্ন দেশ হতে পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা। এছাড়াও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। তথ্যগত সহায়তা মনিজা, যুক্তরাষ্ট্র।
লেখক: Farid Uddin Rony