ইসলাম ডেস্ক : এরইমধ্যে কোরবানির প্রাক-প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশে বহু মানুষ কোরবানি করে থাকেন। এমনকি ইসলাম ধর্মের অন্য কোনো আমল থেকে, এই কোরবানি মানুষ অনেক বেশি পালন করে থাকেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, এক্ষেত্রে অনেকে বিভিন্ন ভুল করে থাকেন। যার ফলে তাদের কোরবানি শুদ্ধ হয় না। কোরবানি সম্পর্কে প্রচলিত এসব ভুল ধারণা নিয়ে আজ আমাদের সঙ্গে আছেন মুফতি জাবের কাসেমী।
কোরবানির ব্যাপারে নিজের ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার রাখা: মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে আরবে বিভিন্ন প্রতিমার নামে পশু উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। ইসলাম আসার পর এসব নিষেধ করা হয়েছে।
ইসলাম একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার উদ্দেশ্যে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছে। আর ইসলামি ধারণার কোরবানির অর্থ হলো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় শরিয়ত নির্ধারিত কোনো প্রিয় বস্তু আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করা এবং শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় তা ব্যবহার করা।
আল্লাহ তা’আলা কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন, ‘তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড় এবং কোরবানি কর।’ (সুরা কাউছার, আয়াত ২) এ আয়াতে নামাজ ও কোরবানিকে একসঙ্গে উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নামাজ যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশে পড়া যায় না, কোরবানিও তেমনিভাবে অন্য কারো উদ্দেশে করা যায় না। এ জন্য কোরবানির ক্ষেত্রে আমাদেরকে জাহেলি ধারণা বাদ দিতে হবে, ইসলামি ধারণা গ্রহণ করতে হবে।
নিয়ত বিশুদ্ধ করা: আমরা বিভিন্ন নিয়তে কোরবানি করে থাকি, কেউ কোরবানি করি সামাজিক মর্যাদা হিসেবে। সমাজে আমার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, সুতরাং কোরবানি না দিলে আমার মর্যাদা থাকবে না। কেউ কোরবানি করি চক্ষুলজ্জা থেকে বাঁচতে। কেউ কোরবানি করি গোশত খেতে। এ জাতীয় উদ্দেশ্যে করলে কোরবানি কবুল হবে না। ছোট কিংবা বড় যে পশুই কোরবানি করা হোক না কেন, তা হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হলে কোরবানি কবুল হবে না।
আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া’। (সুরা হজ, আয়াত ৩৭)
আল্লাহর নামে কোরবানি দেয়া: সাধারণত আমাদের সমাজে ব্যক্তির নামে কোরবানির কথা বলা হয়। যেমন, বাবার নামে অথবা মায়ের নামে কোরবানি দেব। এমনটা বলা ঠিক নয়। কারণ, কোরবানি একটি আর্থিক ইবাদত, যা হবে আল্লাহর নামে, ব্যক্তির নামে নয়। এ জন্য বলা যেতে পারে অমুকের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি। যদিও কারো নামে কোরবানির দ্বারা তার পক্ষ থেকে আদায় করা উদ্দেশ্য হয়, তারপরও এমনটি না বলা।
আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তা ভক্ষণ করো না যেগুলো আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নামে জবাই করা হয়’। (সুরা আনআম, আয়াত ১২১)
হাসিল ছাড়া কোরবানি করা: অনেকে মনে করেন হাসিল না দিলে কোরবানি হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়। হাসিল হাটের ভাড়া। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক, যা হাটের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে নেয়া হয় । তাই এ টাকা পরিশোধ করা জরুরি। হাসিল না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গোনাহ হবে।
পশু জবাই করার জন্য ধারালো ছুরির ব্যবস্থা করা: নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তা’আলা সবকিছুর ওপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব, যখন তোমরা কোনো পশুকে হত্যা করবে তাহলে উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর, যখন জবেহ করবে, তখন উত্তম পদ্ধতিতে জবেহ কর। এবং প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দেবে। যেন জবাইয়ে প্রাণীর বেশি কষ্ট না হয়। (সহিহ মুসলিম হাদিস ১৯৫৫)
নিজের পশু নিজেই জবাই করা: অনেকে মনে করেন, ইমাম বা মাদরাসার ছাত্র দ্বারা জবাই করা জরুরি। আসলে বিষয়টা এমন নয়। বরং নিজে জবাই করা মুস্তাহাব। অক্ষম হলে অন্য কোনো মুসলমান দিয়ে জবাই করা যেতে পারে। তবে ইমাম, উলামায়ে কেরাম ও ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসার কারণে তাদের দ্বারা কোরবানি করালে দোষের কিছু নেই।
কোরবানির সময় দাতাদের নাম পাঠ করা জরুরি নয়: কোরবানির সময় দাতাদের নাম কাগজে লিখে হাতে নিয়ে পাঠ করাকে অনেকে জরুরি মনে করেন। অথচ কোরআন-হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি হচ্ছে তা আল্লাহ তা’আলা ভালো করে জানেন। আল্লাহ তা’আলা কোরআন মজিদে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন বিষয়।’ (সুরা আল আলা, আয়াত ৭)
জবাইয়ের আগে লম্বা দোয়া পড়া জরুরি: আমরা অনেকেই এই অজুহাতে কোরবানি করি না যে, আমার তো দোয়া মুখস্থ নেই। অথচ জবাইয়ের আগে হাদিসে বর্ণিত দোয়াটি পড়া উত্তম। কিন্তু জরুরি নয়। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলে জবাই করলে পশু জবাই শুদ্ধ হয়ে যাবে। (বুখারি শরিফ হাদিস ৫২৩৮)
জবাইকারী ও তার সহযোগীদের বিসমিল্লাহ পড়া জরুরি: জবাইকারী এবং তার সঙ্গে সহযোগীরা যদি জবাইয়ের সময় ছুরিতে হাত লাগায় তাহলে প্রত্যেককে বিসমিল্লাহ বলতে হবে। এদের কেউ যদি ইচ্ছাপূর্বক জবেহর সময় বিসমিল্লাহ না পড়ে, তাহলে পশু কোরবানি হবে না। (রদ্দুল মুহতার, পৃষ্ঠা: ৬/৩৩৪)
জবাইয়ের সময় পশুর চারটি রগের তিনটি কাটা নিশ্চিত করতে হবে: অনেক সময় জবাইয়ের পর কসাই ভাইয়েরা ছোট ছুরি দিয়ে পশুর গলায় জোরে আঘাত করেন, যা সম্পূর্ণ নাজয়েজ ও গর্হিত কাজ। এতে পশু হত্যা করা হলো। এ জন্য প্রাণীর চারটি রগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটা নিশ্চিত করতে হবে। চারটি রগ হলো শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ও দুটি রক্তনালি। – মুফতি জাবের কাসেমী, ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ