বুধবার, ০৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৬:০৫:০৯

হযরত উমর (রা.) যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন

হযরত উমর (রা.) যেভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন

ইসলাম ডেস্ক: হযরত হামযা (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আরেকজন কুরাইশ বীর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান। অবশ্য এটি ছিল রাসূলের বিশেষ দো’আর ফসল। কেননা তিনি খাছভাবে দো‘আ করেছিলেন যে, اللهم أعز الإسلام بأحب الرجلين إليك، بعمر بن الخطاب أو بعمرو بن هشام- ‘হে আল্লাহ! ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব অথবা আমর ইবনু হেশাম (আবু জাহ্ল) এই দু’জনের মধ্যে তোমার নিকটে যিনি অধিকতর প্রিয় তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর’। পরের দিন সকালে তিনি এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং কা‘বা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করলেন’। অতঃপর ওমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে প্রমাণিত হ’ল যে, তিনিই ছিলেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয়।

ওমর ছিলেন অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ এবং পিতৃধর্মের প্রতি অন্ধ আবেগ পোষণকারী। একই কারণে তিনি ছিলেন ইসলামের একজন বিপজ্জনক শত্রু। সে কারণেই একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তরবারি নিয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে নু‘আইম বিন আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে দেখা হল, যিনি তার ইসলাম গোপন রেখেছিলেন।

তিনি বলেন, কোথায় চলেছ ওমর? তিনি বললেন, أريد محمدا هذا الصابئ، الذى فرَّق أمر قريش وسفّه أحلامها وعاب دينها وسبّ آلهتها فأقتله ‘আমি এই বিধর্মী মুহাম্মাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। এ ব্যক্তি কুরায়েশদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে, তাদের ধর্মে দোষারোপ করেছে, তাদের উপাস্যদের গালি দিয়েছে। অতএব আমি তাকে হত্যা করব’।

নু‘আইম বললেন, كيف تأمن بنى هاشم و بنى زهرة وقد قتلتَ محمدًا؟ তাকে হত্যা করে বনু হাশেম ও বনু যোহরা থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? ওমর বললেন, ما أراك إلا قد صَبَوْتَ وتركتَ دينَك الذى كنتَ عليه তুমিও দেখছি পূর্ব পুরুষের ধর্ম পরিত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে গেছ’? নু‘আইম বললেন, আমি কি তোমাকে একটি আশ্চর্যজনক খবর দেব না? ওমর বললেন, কি খবর? নু‘আইম বলল, إن أختك وختنك قد صبوا وتركا دينك الذى كنت عليه- ‘তোমার বোন ও ভগ্নিপতি বেদ্বীন হয়ে গেছে এবং তারা তোমার ধর্ম পরিত্যাগ করেছে’।

এতে ওমরের আত্মসম্মানে ঘা লাগলো এবং ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বোনের বাড়ীর দিকে ছুটলেন। হযরত খাববাব ইবনুল আরত ঐসময় ঘরের মধ্যে গোপনে স্বামী-স্ত্রীকে কুরআনের সূরা ত্বোয়াহা-এর তা‘লীম দিচ্ছিলেন। ওমরের পদশব্দে হতচকিত হয়ে তিনি ঘরের এক কোণে লুকিয়ে যান। ওমর ঘরে ঢুকে বললেন, শুনলাম তোমরা দু’জনে বেদ্বীন হয়ে গেছ?

ভগ্নিপতি সাঈদ বললেন, أرأيت إن كان الحق فى غير دينك؟ ‘হে ওমর! যদি আপনার ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে সত্য নিহিত থাকে, তবে সেবিষয়ে আপনার রায় কি’? একথা শুনে ওমর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ভগ্নিপতির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতে থাকলেন। তখন বোন (ফাতেমা) তাকে স্বামী থেকে পৃথক করে দিলেন। এতে ওমর ক্ষিপ্ত হয়ে বোনের গালে জোরে চপেটাঘাত করলেন। তাতে বোনের মুখমন্ডল রক্তাক্ত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বোন তেজস্বী কণ্ঠে বলে উঠলেন, يا عمر إن كان الحق فى غير دينك أشهد أن لا إله إلا الله وأشهد أن محمدا رسول الله- ‘হে ওমর! তোমার ধর্ম ছাড়া যদি অন্য ধর্মে সত্য থাকে? বলেই তিনি সোচ্চার কণ্ঠে কলেমায়ে শাহাদাত উচ্চারণ করলেন (আর-রাহীক্ব) এবং বললেন, قد أسلمنا و آمنا بالله و رسوله فاصنع ما بدا لك- ‘আমরা ইসলাম কবুল করেছি এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর ঈমান এনেছি। এক্ষণে তোমার যা খুশী কর’ (ইবনু হিশাম)।

বোনের রক্তাক্ত চেহারা দেখে এবং তার মুখে এ দৃপ্ত সাক্ষ্য শুনে ওমরের মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিল। তিনি লজ্জিত হলেন ও দয়ার্দ্র কণ্ঠে বললেন, তোমাদের কাছে যে পুস্তিকাটা আছে, ওটা আমাকে একটু পড়তে দাও’। বোন সরোষে বললেন, إنك رجس ولا يمسه إلا المطهَّرون فقم واغتسل তুমি অপবিত্র। ঐ কিতাব পবিত্র ব্যক্তি ভিন্ন স্পর্শ করতে পারে না। ওঠ, গোসল করে এসো’। ওমর তাই করলেন। অতঃপর কুরআনের উক্ত খন্ডটি হাতে নিয়ে সূরা ত্বোয়াহা পড়তে শুরু করলেন। যখন ১৪তম আয়াত পাঠ করলেন إِنَّنِي أَنَا اللهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي- ‘নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। অতএব তুমি আমারই ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪)।

এ আয়াত পাঠ করেই ওমর বলে উঠলেন, ما أحسنَ هذا الكلام وأكرمَه؟ دلونى على محمد- ‘কতই না সুন্দর ও কতই না মর্যাদাপূর্ণ এ বাণী? তোমরা আমাকে মুহাম্মাদ কোথায় বাৎলে দাও! অন্য বর্ণনায় এসেছে, ১৫ আয়াত পর্যন্ত إِنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيْهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى- ‘নিশ্চয়ই ক্বিয়ামত আসবে। আমি এটা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্যানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’। এ পর্যন্ত পাঠ করেই তিনি বলে ওঠেন, ما أطيبَ هذا الكلام و أحسنَه- ‘কতই না পবিত্র ও কতই না সুন্দর এ বাণী!’

ওমরের একথা শুনে খাববাব গোপন স্থান থেকে ত্বরিৎ বেরিয়ে এসে বললেন, أبشر يا عمر فإنى أرجو أن تكون دعوة الرسول صلى الله عليه وسلم لك ليلة الخميس- ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর হে ওমর! আমি আশা করি গত বৃহস্পতিবার রাতে আল্লাহর রাসূল যে দো‘আ করেছিলেন তা তোমার শানে কবুল হয়েছে’। চল আল্লাহর রাসূল ছাফা পাহাড়ের পাদদেশের বাড়ীতে অবস্থান করছেন।

যথাসময়ে কোষবদ্ধ তরবারি সহ ওমর সেখানে উপস্থিত হ’লেন। তাঁকে তরবারিসহ দেখে হামযা (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সবাই তাকে মোকাবিলার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন। হামযা সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, তাকে স্বাচ্ছন্দে আসতে দাও। যদি সে সদিচ্ছা নিয়ে এসে থাকে তবে ভাল। নইলে তরবারি দিয়েই তার ফায়ছালা করা হবে’।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ওমরের জামার কলার ও তরবারির খাপ ধরে জোরে টান দিয়ে বললেন, অলীদ বিন মুগীরাহ্র মত অপদস্থ ও শাস্তিপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কি তুমি বিরত হবে না’? অতঃপর আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, اللهم هذا عمر بن الخطاب، اللهم أعز الإسلام بعمر بن الخطاب ‘হে আল্লাহ! এই যে ওমর! হে আল্লাহ তুমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাবের মাধ্যমে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি কর’। এই দো‘আর প্রভাব ওমরের উপরে এমনভাবে পড়ে যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, أشهد أن لآ إله إلا الله وأنك رسولُ الله- ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল’। সাথে সাথে তিনি ইসলাম কবুল করলেন এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) ও গৃহবাসী ছাহাবীগণ এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি করলেন যে, মসজিদুল হারাম পর্যন্ত সে আওয়ায পৌঁছে গেল’।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/জেএম/আরএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে