মুফতি জহির রায়হান : ইমাম মাহদির ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলো দুভাগে বিভক্ত। (১) যে সব হাদিসে সরাসরি ইমাম মাহদির বর্ণনা এসেছে। (২) যে সব হাদিসে শুধু তার গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম মাহদির ব্যাপারে প্রায় অর্ধশত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এর কিছু সহিহ, কিছু হাসান, আর কিছু যয়ীফ বা দূর্বল।
প্রায় আঠারটির মতো আছার (সাহাবাদের বাণী) বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ ছাফারিনী, সিদ্দিক হাসান খান এবং হাফেয আবেরী (রহ.) ইমাম মাহদি সংক্রান্ত হাদিসগুলোকে পৌনঃপুনিকতার (মুতাওয়াতির) স্তরে উন্নীত করেছেন।
বিন বায (রহ.) বলেন, ইমাম মাহদি প্রকাশের বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ। এ ব্যাপারে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রচুর হাদিস প্রমাণিত রয়েছে। একাধিক সাহাবী (রা.) থেকে পরস্পর বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালার অপার রহমতে তিনি শেষ জামানায় ইমাম হবেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। অন্যায়-অবিচার দমন করবেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেন। তার আত্মপ্রকাশে উম্মতের মধ্যে জিহাদের চেতনা ফিরে আসবে। সকলেই এক কালেমার পতাকাতলে একত্রিত হয়ে যাবে।
যে সব হাদিসে সরাসরি ইমাম মাহদির কথা আলোচিত হয়েছে:
(১) হজরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার শেষ উম্মতের মাঝে মাহদি প্রকাশ পাবে। আল্লাহ তাআলা তাদের উপর কল্যাণের বারিধারা বর্ষণ করবেন। ভূ-পৃষ্ঠ গচ্ছিত সকল খনিজ সম্পদ উন্মোচন করে দিবে। ধন-সম্পদের সুসম বন্টন নিশ্চিত করবে। গবাদিপশু বৃদ্ধি পাবে। মুসলমানদের হারানো মর্যাদা ফিরে আসবে। সাত বা আট বছর তার রাজত্ব হবে। (মুস্তাদরাকে হাকিম-৪/৫৫৭-৫৫৮)
(২) হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মাহদি আমার বংশধর। এক রাত্রিতে আল্লাহ তাআলা তাকে নেতৃত্বের যোগ্য বানিয়ে দেবেন। (আল-মুসনাদ-২/৫৮)
বুঝা গেলো, ইমাম মাহদি (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ) নিজেও জানবেন না যে, হাদিসে উল্লেখিত ব্যক্তিটি তিনিই। আগেভাগে গিয়ে খিলাফতও কামনা করবেন না। নম্রতাবশত নিজেকে তিনি নেতৃত্বের অযোগ্য মনে করবেন। আর তাই প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষ জোর করে তার হাতে বাইয়াত হয়ে যাবে।
ইমাম মাহদি কোনো পাপী বা পথভ্রষ্ট হবেন না। (যেমন মিথ্যা মাহদির দাবিদার গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী পাপী ও পথভ্রষ্ট।) বরং শরীয়ত বিষয়ে একজন সুপরিপক্ব ব্যক্তি হবেন। মানুষকে হালাল-হারাম শেখবেন।বিচারব্যবস্থাকে শরীয়তের আলোকে ঢেলে সাজাবেন। শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রধান সেনাপতির ভূমিকা পালন করবেন। তিনি-ই প্রতীক্ষিত মাহদি। এক রাত্রিতে আল্লাহ তাআলা নেতৃত্বের সার্বিক যোগ্যতা তাকে প্রদান করবেন।
(৩) হজরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মাহদি আমার বংশে ফাতেমার সন্তানদের মধ্যে হবে। (আবূ দাউদ-১১/৩৭৩)
(৪) হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মরিয়ম-তনয় ঈসা (আ.) আসমান হতে অবতরণ করবেন। মুসলমানদের সেনা প্রধান মাহদি তাকে স্বাগত জানিয়ে বলবেন, আসুন! নামাজের ইমামতি করুন। ঈসা (আ.) বলবেন, না, (তুমিই ইমামতি করো)। তোমাদের একজন অপরজনের নেতা। এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআ'লার পক্ষ থেকে এ এক মহা সম্মান। (ইবনুল কাইয়িম রহ.-এর 'আল-মানারুল মুনীফ' ১৪৭-১৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেন, হারেস বিন আবূ উসামা স্বীয় মুসনাদে সবল সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)।
এ হাদিস দ্বারা বুঝা গেলো, ইমাম মাহদির সময়েই দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। অতঃপর দাজ্জালকে হত্যা করতে আসমান থেকে হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম আসমান থেকে অবতরণ করবেন। ইমাম মাহদিই তখন সেনা প্রধান থাকবেন।
হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম এবং অন্য সকল মুসলমান ইমাম মাহদির পেছনে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। নামাজ শেষে হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিবেন আর ইমাম মাহদি তার সেনাদলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা সদস্য হবেন।
(৫) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীর জীবনসায়াহ্নে যদি একটি মাত্র দিন অবশিষ্ট থাকে, তবে সে দিনটিকে আল্লাহ তাআলা দীর্ঘ করে আমার পরিবারস্থ একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন। তার নাম আমার নাম এবং তার পিতার নাম আমার পিতার নাম সদৃশ হবে। (তিরমিযী-২২৩০/আবূ দাউদ-৪২৮৪)
সুতরাং শিয়া সম্প্রদায়ের দাবি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ, মুহাম্মাদ বিন হাসান আসকারীকে তারা মাহদি মনে করে থাকে। অথচ মাহদি তো হবেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রা.।
উপরের হাদিসসমূহে নাম ও গুণাগুণসহ স্পষ্টরূপে ইমাম মাহদির রা.-এর কথা আলোচিত হয়েছে। এখন আলোচনা করব সেসব হাদিস যে সকল হাদিস ইমাম মাহদির প্রতি পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করে।
যে সব হাদিস ইমাম মাহদির প্রতি পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করে:
(১) উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিদ্রাবস্থায় কেমন যেন করছিলেন। (জাগ্রত হওয়ার পর) জিজ্ঞেস করলাম, এমন করছিলেন কেনো হে আল্লাহর রাসুল? বললেন, খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আমার উম্মতের কিছু লোক কাবা ঘরে আশ্রিত কুরায়শী ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে রওনা হবে।
বাইদা প্রান্তরে পৌঁছা মাত্র সবাইকে মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। আমরা বললাম, পথে তো অনেক মানুষের সমাগম থাকে!! নবীজী বললেন, হ্যাঁ! দর্শক, অপারগ এবং পথিক সকলকেই একত্রে ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে। তবে অন্তরেচ্ছা অনুযায়ী আল্লাহপাক তাদের পুনরুত্থান করবেন। (মুসলিম-৭৪২৬)
অর্থাৎ ইমাম মাহদিকে হত্যা করতে আসা সেই নামধারী মুসলিম বাহিনীকে আল্লাহ তাআলা বায়দা প্রান্তরে ধ্বসিয়ে দিবেন। তবে কেয়ামতের দিন নিয়ত অনুযায়ী সবাইকে উঠানো হবে। সৎ নিয়তের দরুন কেউ জান্নাতে যাবে। অসৎ নিয়তে কেউ জাহান্নামে যাবে।
(২) হজরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কেমন হবে- যখন তোমাদের মাঝে মরিয়ম-তনয় ঈসা (আ.) অবতরণ করে তোমাদের-ই একজনের পেছনে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। (মুসলিম-৪০৯)
অন্য বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, ইমাম মাহদিই (আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ) হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের ইমামতি করবেন।
(৩) উম্মুল মুমিনীন হজরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন, জনৈক খলীফার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধ সৃষ্টি হবে। মদিনার একজন লোক তখন পালিয়ে মক্কায় চলে আসবে। মক্কার লোকেরা তাকে খুঁজে বের করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুকন এবং মাকামে ইব্রাহিমের মাঝামাঝি স্থানে বাইয়াত গ্রহণ করবে। বাইআতের খবর শুনে শামের দিক থেকে এক বিশাল বাহিনী প্রেরিত হবে। মক্কা-মদিনার মাঝামাঝি বাইদা প্রান্তরে তাদেরকে মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেওয়া হবে।
বাহিনী ধ্বসের সংবাদ শুনে শাম ও ইরাকের শ্রেষ্ঠ মুসলমানগণ মক্কায় এসে রুকুন ও মাকামে ইব্রাহিমের মাঝামাঝিতে তার হাতে বায়আত গ্রহণ করবে। অতঃপর বনু কালব সম্বন্ধীয় এক কোরায়শীর আবির্ভাব হবে। শামের দিক থেকে সে বাহিনী প্রেরণ করবে। মক্কার নবউত্থিত মুসলিম বাহিনী তাদের উপর বিজয় হয়ে প্রচুর যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ অর্জন করবে।
সেদিন বনু কালবের সর্বনাশ ঘটবে। যে বনু কালব থেকে অর্জিত সম্পদ প্রত্যক্ষ করেনি, সে-ই প্রকৃত বঞ্চিত। অতঃপর মানুষের মাঝে তিনি সম্পদ বন্টন করবেন। নববী আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাবেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ইসলাম সেদিন ভূ-পৃষ্ঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। সাত বছর এভাবে রাজত্ব করে তিনি ইন্তেকাল করবেন। মুসলমানগণ তার জানাজায় শরিক হবে। (আবূ দাউদ-৪২৮৮)
প্রায় ত্রিশোর্ধ-জন সাহাবি থেকে ইমাম মাহদি (রা.) সংক্রান্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত হাদিস গবেষকগণ শক্তিশালী বর্ণনাসূত্রে এগুলো বর্ণনা করেছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল উলামায়ে কেরাম ইমাম মাহদির প্রকাশের বিষয়ে একমত।
লেখক: প্রধান মুফতি ও ভাইস প্রিন্সিপাল, জিয়াউল উলূম মাদ্রাসা, বরাকৈর, ধামরাই, ঢাকা।