রাকিব হাসান : সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় একজন লোকের সাতজন স্ত্রীর একটি নিউজ ভাইরাল হয়েছে। কুষ্টিয়ার রবিজুল নামে ওই ব্যক্তি একইসঙ্গে সাত নারীর সঙ্গে সংসার করার কথা জানিয়েছেন। তিনি যেহেতু ধর্মাবলম্বী হিসেবে একজন মুসলিম, তাই তার এ কাণ্ডটি ইসলামী আইনে বৈধ কি না তা জানা জরুরি।
একসঙ্গে সাতজন স্ত্রী রাখার ব্যাপারে ইসলামে কোনো বাধা নিষেধ আছে কিনা? কখন একাধিক বিয়ে বৈধ এবং কি কি শর্তারোপ করা হয়েছে ইসলামী আইনে এ বিষয়গুলো জানা প্রতিটি মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকেই একাধিক বিয়ে করে আত্মঅহংকার করে প্রশাংসায় পঞ্চমুখ হন আবার কেউ এটিকে চরমভাবে ঘৃণা করেন। আবার লোকমুখে শোনা যায়, একজন পুরুষের জন্য চার বিয়ে সুন্নত। আসলেই কি এটি সুন্নত? এ লেখায় আমরা একাধিক বিয়ে সম্পর্কে ইসলামী আইনের দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করব।
প্রথমেই বিয়ের হুকুম সম্পর্কে জানবো। মানুষের শারিরীক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় বিয়ের হুকুমও বিভিন্ন রকম হয়।
যেমন (১)ফরজ: যাদের সব রকমের সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু বিয়ে না করলে জেনায় নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের জন্য বিয়ে করা ফরজ।
(২)সুন্নত:যাদের সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু জেনায় লিপ্ত হওয়ার আশংকা নেই।
(৩)মুবাহ: যাদের সামর্থ আছে কিন্তু পাপে লিপ্ত হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
(৪)মাকরুহ:বিয়ে করলে যাদের স্ত্রী জুলুমের শিকার হবেন এবং তাদের অধিকার যথাযথভাবে পাবে না এমন আশংকা সৃষ্টি হলে।
(৫) হারাম: যাদের কোন শারিরীক যোগ্যতা নেই, ভরণপোষণের সামর্থ নেই।
উপরোক্ত হুকুমগুলো যে কোন একটি বিবেচনা হবে ব্যক্তির সক্ষমতা অনুযায়ী।
একাধিক বিয়ে শর্তাবলি: একের অধিক বিয়ে শর্তযুক্ত। শর্তপূরণের সাপেক্ষেই এটি হালাল হয়।
১.ন্যায়পরায়ণতা থাকতে হবে। প্রত্যেক স্ত্রীর সঙ্গেই ইনসাফপূর্ণ সহাবস্থান করতে হবে। কোন প্রকার বাহ্যিক বৈষম্য করতে পারবে না যদি বৈষম্য করে তাহলে এ কারণই তার বিপদ বয়ে আনবে।
এ ব্যপারে নবীজী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির দুইজন স্ত্রী আছে, কিন্তু তার মধ্যে একজনের দিকে বেশি ঝুঁকে যায়, এমন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অর্ধদেহ ধসা অবস্থায় উপস্থিত হবে।’ (আহমেদ ২/৩৪৭; আসবে সুনান; হাকিম ২/১৮৬) ইবনে হিব্বান ৪১৯)।
২.সমতা বিধান না করতে পারলে একটি বিবাহে সন্তুষ্ট থাকতে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমতা বিধান না করতে পারলে একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ।
আল্লাহ বলেন, আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনেই সন্তুষ্ট থাক। (সুরা নিসা : ৩)
আল্লাহ আরো বলেন, তোমরা কখনও স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না যদিও তোমরা তা প্রত্যাশা করো। (সূরা নিসা: ১২৯)
ইসলাম বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করেনি তবে নিরুৎসাহিত করেছে। অর্থাৎ ঢালাওভাবে সব পুরুষের জন্য সব পরিস্থিতিতে বহুবিবাহকে আল্লাহ জায়েজ করেননি।
আমাদের দেশে অনেকের এ ভুল ধারণা রয়েছে যে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ সওয়াবের কাজ। ধারণাটি ভুল। বিশেষ অবস্থায় শর্তসাপেক্ষে এটি মুবাহ মাত্র। অপ্রয়োজনে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন। (দ্রষ্টব্য- নিসা : ৩)।
সৌদি আরবের প্রখ্যাত আলেম শাইখ নাসের আল বাররাককে প্রশ্ন করা হয়, একাধিক বিয়ে করা সুন্নত নাকি মুবাহ? তিনি উত্তরে বলেন, প্রয়োজনে তা মুবাহ ও শরিয়ত অনুমোদিত।
আরেকটি বিষয় জানা জরুরি তা হলো একাধিক বিয়ের বিষয়টিকে ঘৃণা করা। কেউ যদি ইসলামের অনুমোদিত একাধিক বিয়ে মনেপ্রাণে ঘৃণা ও অপছন্দ করেন তাহলে তার ইমান নষ্ট হয়ে যাবে।
আল্লাহ বলেন, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মনে না করে। এরপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে। (সুরা নিসা ৬৫)
ইসলামে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে একাধিক বিয়ে করা অনুমোদিত। ইসলামে এর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তা হল, দুই, তিন অথবা চার। ইসলাম পূর্ব যুগে এর কোন সীমা-সংখ্যা ছিল না। ইসলাম এর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সুতরাং একসঙ্গে চারের অতিরিক্ত বিয়ে করা জায়েজ নাই (সূরা নিসা: আয়াত ৩)
একঙ্গে চারের অধিক স্ত্রী রাখা হারাম
এ ব্যাপারে হাদিস হচ্ছে- ইবনু ওমর (রা.) বলেন, ‘যে সময়ে গাইলান ইবনু সালামাহ আছ-ছাক্বাফী ইসলাম গ্রহণ করেন, সে সময়ে তার দশজন স্ত্রী ছিল, যাদের তিনি জাহিলী যুগে বিয়ে করেছিলেন। তার সঙ্গে সাথে তারাও মুসলিম হয়। রাসুল (ﷺ) তাকে এদের মধ্যে হতে যে কোন চারজনকে বেছে নেয়ার নির্দেশ দেন’ (তিরমিযী, হা/১১২৮)।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে যেহেতু পার্সোনাল ল শরীয়া অনুসারেই পরিচালিত হয়, তাই এসব বিষয়ে শরিয়তের বিধান ও নারীর সম্মান যেন ধূসরিত না হয় সে বিষয়ে রাষ্ট্রের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আলেম ও সামাজিক দায়িত্বশীলদের উচিত- যারা চারের অধিক স্ত্রী নিয়ে একসঙ্গে ঘরসংসার করছে তাদের ব্যাপারে শরিয়তের বিধান অনুযায়ী স্ত্রীর সংখ্যা নির্ধারিত করে দেওয়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, বিভাগ: আল ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ(LL.B)