ইসলাম ডেস্ক : বর্তমান বিশ্বে সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষ বাস করছে। ধর্ম পরিচয়ে তাদের কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিস্টান, কেউ ইহুদি, কেউ হিন্দু কেউবা বৌদ্ধ। অনেকে আবার কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না।
তারা নিজেদেরকে নাস্তিক বা বস্তুবাদী পরিচয় দেয়। সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা সবচে বেশি। ইহুদিদের সংখ্যা সবচে কম। মুসলিমরা সংখ্যায় প্রায় ২০০ কোটি। এই ২০০ কোটি মুসলমানের প্রত্যেকেই মুমিন হওয়ার দাবিদার।
বস্তুত যারা আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করেছেন এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহর বান্দা ও রাসুল হিসেবে মেনে নিয়েছেন, তারাই মুমিন, তারাই মুসলমান।
আর ঈমানের সঙ্গে সঙ্গে আমলে সালেহ তথা নেক কাজ থাকলে সে প্রকৃত ও সফল মুমিন, সে জান্নাতি। ঈমান গ্রহণের পর সেই ঈমানের কিছু দাবি থাকে, ঈমানের সেই দাবি পুরা করাই হলো আমলে সালেহ। প্রকৃত সফল মুমিনের পরিচয় স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কুরআনে দিয়েছেন। সাত ধরনের গুণে গুণান্বিত মুমিনগণ সফল। তারা জান্নাতে চিরকাল থাকবে।
প্রথম প্রকার হচ্ছে, যারা নামাজে বিনয়ী ও নম্র হয়। এই গুণ খুশুখুজুর দ্বারা অর্জন হয়। অন্তর ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্থিরতাকে বলা হয় খুশু। আর আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা হলো খুজু।
নামাজে খুশুখুজু তথা বিনয় ও নম্রতা আনার মাধ্যম হলো আল্লাহকে হাজির-নাজির জানা। আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য সামনে রেখে নামাজ পড়া। কেননা যেকোনো ক্ষেত্রে বড়দের উপস্থিতি অনুভব হলে অধীনস্থরা গুরুত্ব ও একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করে থাকে। অতএব, আল্লাহকে হাজির-নাজির জ্ঞান করে তার বড়ত্ব-মাহাত্ম্য মাথায় রাখলে বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবে।
দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে, যারা অনর্থক-অহেতুক কথা, কাজ ও চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ, এমন কথা বা কাজ, দুনিয়াতে যার কোনো উপকার নেই, আখেরাতে কোনো সওয়াব নেই।
যেসব মুমিন অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে, তারা ঈমানের অন্যতম সিফাত অর্জনকারী। সাহাবি হযরত উকবা ইবনে আমের (রা.) নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! নাজাত (মুক্তি) কী? উত্তরে নবীজি (সা.) তিনটি কথা ইরশাদ করলেন- ক. তোমার ওপর তোমার জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করো। অর্থাৎ, তোমার জিহ্বাকে অনর্থক ও বেহুদা কাজ থেকে বিরত রাখো।
আল্লাহ তায়ালা সুরা কাফ এর ১৮নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন- ‘বান্দা তার মুখ থেকে যে কথাই উচ্চারণ করে, তা-ই লিপিবদ্ধ করার জন্য তার কাছেই রয়েছে অতন্দ্র প্রহরী ফেরেশতা।’ কথাটি নেক হলে ডান কাঁধের ফেরেশতা আর খারাপ হলে বাম কাঁধের ফেরেশতা লিপিবদ্ধ করে নেয়। (বয়ানুল কুরআন)।
খ. তোমার ঘর যেন কষ্ট করে। এ কথার ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা তীবী (রহ.) বলেন, তোমার ঘর যেন আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে ভরপুর থাকে। অহংকার মুক্ত থাকে।
আবার কোনো কোনো মুহাদ্দিস এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য যে স্ত্রী, সন্তান, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি দুনিয়ার আসবাবপত্র বণ্টন করেছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকো এবং দ্বীনের বিষয়ে তোমার চেয়ে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্নের দিকে তাকাও। আর দুনিয়ার বিষয়ে তোমার চেয়ে নিম্ন শ্রেণির দিকে লক্ষ করো। যাতে আল্লাহর নেয়ামত তোমার কাছে তুচ্ছজ্ঞান না হয়।
গ. তোমার কৃত গুনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হও। এ তিনটি কাজ করলে তুমি নাজাত পাবে। (তিরমিজি : ২৪০৬)
তৃতীয় প্রকার হচ্ছে, যারা জাকাত আদায় করে। ধন সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি কাউকে বিত্তশালী, কাউকে রিক্তহস্ত বানান। যাদেরকে বিত্ত দান করেন, তাদেরকে শরিয়ত নির্ধারিত হারে তথা শতকরা আড়াই শতাংশ জাকাত হিসাবে হত-দরিদ্র, গরিব-দুঃখীকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বারবার ইরশাদ করেছেন, তোমরা জাকাত আদায় করো। যারা মালের জাকাত আদায় করে নিজের সম্পদ পবিত্র করে, তারা মুমিনের বিশেষ গুণে গুণান্বিত।
চতুর্থ প্রকার হচ্ছে, যারা নিজেদের লজ্জাস্থানকে সংযত রাখে। অপাত্রে অবৈধ স্থানে এর ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। হজরত সাহাল ইবনে সাআদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থান অপাত্রে ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দেবে, আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব (বুখারি : ৬৪৭৪)। চোখের হেফাজত লজ্জাস্থান সংযত রাখার ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক। অতএব, দৃষ্টিকে সংযত রাখতে হবে। বেগানা নারী, অশ্লীল ছবি ও ফিল্ম দেখা থেকে চোখকে হেফাজত করতে হবে।
পঞ্চম প্রকার হচ্ছে, যারা আমানত রক্ষা করে, আমানতে খেয়ানত করে না। মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা নিসার ৫৮ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমানতগুলো তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দাও।’
আমানত দুই ধরনের হতে পারে- ক. গচ্ছিত সম্পদ। খ. অর্পিত দায়িত্ব। পরিবার, সমাজ, অফিস-আদালত ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্বও আমানত। সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন না করলে খেয়ানত হবে।
খেয়ানত পরিমাণ বেতন-ভাতা বৈধ হবে না। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে যে দ্বীন ও শরিয়ত উম্মতের কাছে রেখে গেছেন তাও আমানত। অতএব, দ্বীন ও শরিয়তকে সংরক্ষণ করা, এর দাবি পূর্ণ করা উম্মতের ওপর মহান দায়িত্ব।
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির আমানতদারিতা নেই, তার ঈমান পরিপূর্ণ নয় (মুসনাদে আহমাদ : ১২৫৬৭)। বৈঠকের কথাবার্তা ও সিদ্ধান্তও আমানত।
কোনো কোনো সাহাবি নবীর দরবারের পরামর্শ বাইরে প্রকাশ করে দিতেন। এতে মুনাফিকরা ইহুদিদেরকে আগে আগে সতর্ক করে দিত। তখন আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং নিজেদের আমানতের বস্তুগুলোতে খেয়ানত করো না।’ (সুরা আনফাল : ২৭)
ষষ্ঠ প্রকার হচ্ছে, যারা ওয়াদা পূর্ণ করে। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা মুমিনের অন্যতম একটি গুণ। ওয়াদা রক্ষা না করা মুনাফিকের নিদর্শন। হাদিস বর্ণনাকারী বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি- ক. মুনাফিক যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে। খ. ওয়াদা করলে তা রক্ষা করে না। গ. আমানত রাখলে খেয়ানত করে (বুখারি : ৬০৯৫)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, অপর এক হাদিসে নবীজি (সা.) ইরশাদ করেন, যার মধ্যে চারটি স্বভাব থাকবে, সে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ চারটির কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তার মধ্যে নিফাকের একটি স্বভাব থাকবে, যতক্ষণ তা পরিত্যাগ না করবে- ১. যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় খেয়ানত করে। ২. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। ৩. যখন ওয়াদা করে প্রতারণা করে তা ভঙ্গ করে। ৪. যখন বিতর্ক করে অন্যায় করে। মুহাদ্দিসিনে কেরাম চতুর্থ স্বভাবে ব্যাখ্যায় বলেন, যখন বিতর্ক ও বিবাদ বা মামলা করে, তখন হক ও সত্য থেকে বের হয়ে মিথ্যা বলে। এমনকি হককে বাতিল আর বাতিলকে হক প্রমাণ করে। (বুখারি : ২৪৫৯)
সপ্তম প্রকার হচ্ছে, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে যত্নবান হয়। নামাজ হলো ঈমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী। ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নামাজ।
হাশরের বিচারিক মাঠে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। সুতরাং, নামাজের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া মুমিনের অন্যতম বিশেষ গুণ। আর নামাজের ব্যাপারে অলসতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন মুনাফিকের কাজ।
সহিহ মুসলিম, আবু দাউদ ও নাসায়িতে উল্লিখিত এক হাদিসে নবীজি (সা.) অলসতা, অবহেলা করে আসরের নামাজ সূর্য ডোবার আগে আগে পড়াকে মুনাফিকের নামাজ আখ্যা দিয়েছেন।
অতএব, প্রকৃত মুমিন হতে হলে নামাজে যত্নবান হতে হবে। উল্লিখিত গুণে যারা গুণান্বিত হবে, তারাই হবে জান্নাতের উত্তরাধিকারী। তারা ফেরদাউস জান্নাতের মালিক হবে, যেখানে তারা চিরকাল থাকবে।
সফল মুমিনের এ গুণগুলো পবিত্র কুরআনের সুরা মুমিনুনের প্রথম নয় আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অতএব, মুমিন জীবনে সফলতা পেতে হলে এগুণগুলো অর্জন করতে হবে। মুমিনের এ সিফাতগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই প্রযোজ্য।
নারী-পুরুষ যে-ই ঈমানের এই গুণগুলো অর্জন করবে তাদের জীবন বরকতময় হবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সুরা আরাফের ৯৬ নং আয়াতে বলেছেন- ‘এসব জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত, তাকওয়া অবলম্বন করত, তা হলে আমি অবশ্যই তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতগুলো উন্মুক্ত করে দিতাম।’ এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, ঈমান ও তাকওয়ার দ্বারা নানা প্রকারের বরকত লাভ হয়ে থাকে। আল্লাহ সবাইকে এগুণগুলো অর্জন করে ভালো মুমিন হওয়ার তওফিক দান করুন।