মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬, ০৫:২৮:৫৩

মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একমাত্র উপায় নামাজ (১ম পর্ব)

মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একমাত্র উপায় নামাজ (১ম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : নামাজ একটি গঠনমূলক ইবাদাত। আল্লাহর সামনে ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে কায়মনোবাক্যে নিজের সচেতন উপস্থিতি ঘোষণা করার অন্যতম একটি প্রধান ইবাদাত হলো নামাজ। মানুষের জীবনদৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক উন্নতির ক্ষেত্রে নামাজের একটি মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। এ কারণেই যারা প্রকৃত নামাজ আদায়কারী,তাদের সাথে অন্যান্যদের আচার-ব্যবহারগত পার্থক্য রয়েছে। এ ধরনের লোকজন মানসিক এবং আত্মিক ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। খুব কমই তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যোগ দেয়। ইসলামে নামাজ হলো সর্বোৎকৃষ্ট ইবাদাত এবং নামাজই হলো স্রষ্টাকে অনুভব করার জন্যে মানব জাতির পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী পন্থা বা উপায়।

ইবাদাত-বন্দেগি করা কিংবা আল্লাহর প্রশংসা বা গুণগান করা মানবাত্মার প্রাচীনতম একটি বৈশিষ্ট্য বা বহিপ্রকাশ। এটা মানুষের সত্ত্বাগত মৌলিক একটি দিক। মানব জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,যখন এবং যেখানেই মানুষের উপস্থিতি ছিল,সেখানেই প্রশংসা-কীর্তন বা প্রার্থনারও অস্তিত্ব ছিল।তবে ইবাদাতের ধরন বা পদ্ধতি কিংবা খোদা বা প্রার্থনীয় সত্ত্বা গোত্রভেদে বিভিন্ন ছিল।কেউ সূর্য বা তারকাকে খোদা বলে মনে করতো,কেউবা আবার কাঠ-পাথরের তৈরী মূর্তিকে পূজা করতো। কিন্তু মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশেষ করে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্যে নবী-রাসূলদের পাঠানোর পর তাঁরা যখন মানুষকে নিজেদের সম্পর্কে ধারণা দিলেন তাদেরকে সচেতন করে তুললেন,তখন তারা সর্বশক্তিমান এক স্রষ্টার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো এবং এক স্রষ্টার ইবাদাতে আত্মনিয়োগ করলো।

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস বলেন,মানুষ তার নিজের একান্ত বন্ধুকে কেবল তার আভ্যন্তরীণ চিন্তারাজ্যেই পেতে পারে। অধিকাংশ মানুষ সচেতনভাবেই হোক কিংবা আনমনেই হোক,ঠিক তার অন্তরের গহীন জগতেই তাকে খুজে বেড়ায়।চিন্তারাজ্যের এই গহীন স্তরে গেলে একজন তুচ্ছ ব্যক্তিও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান বলে উপলব্ধি করে। এই যে মহাকাব্যিক বীর-পালোয়ান সৃষ্টি,বড়ো বড়ো জ্ঞানী-গুণী মনীষী,খোদার পথে কিংবা দেশের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার যে স্পৃহা-এ সবই মানুষের মধ্যকার পবিত্রতার উপলব্ধি থেকে উৎসারিত। কেননা মানুষ চায় প্রশংসনীয় এমন কিছুর অস্তিত্ব যাকে ভালোবেসে পূজা করা যায়। এ কারণেই ইতিহাসের কাল-পরিক্রমায় দেখা গেছে বহু মানুষ নিষ্প্রাণ অপূর্ণ বহু সৃষ্টির পূজা করেছে। যা ছিল মূল পথ থেকে বিচ্যুত।

অনেকেই প্রশ্ন করে মানুষের মাঝে এই যে ইবাদাত করার উপলব্ধি,তাতে তার কী লাভ? বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এবাদাতের অনুভূতিটা আসলে অপূর্ণ সৃষ্টির পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্যে একটা সহজাত প্রচেষ্টা। মানুষ সবসময়ই চায়, তার সীমিত অস্তিত্ব থেকে অসীমতার দিকে পাড়ি জমাতে। এলক্ষ্যেই মানুষ চায় ইবাদাত-বন্দেগির মাধ্যমে এমন এক বাস্তব সত্যে উপনীত হতে,যেখানে সীমা নেই,নোংরামি নেই অপূর্ণতা নেই,বিলয় নেই। ইকবাল লাহোরী যেমনটি বলেছেন,ইবাদাত জীবনের বিকাশমূলক এমন একটি প্রচলিত প্রবণতা যার মাধ্যমে আমাদের ব্যক্তিত্বের ছোট্ট দ্বীপ নিজেকে সামগ্রিক বিশালতার মাঝে উপলব্ধি করে। আইনস্টাইনও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন,একজন তুচ্ছ ব্যক্তিও ইবাদাতের সময় নিজের বিশালত্ব টের পায়।

অবশ্য স্রষ্টার ইবাদাত করার ব্যাপারটি কেবল মানুষেরই স্বতন্ত্র প্রবণতা নয়। সৃষ্টি জগতের সবকিছুই মূলত আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদিত। বিশ্বের সকল বস্তুই আল্লাহর অনুগ্রহে সঞ্চরণশীল। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের দৃষ্টিতে পৃথিবীর প্রতিটি অনু-পরমাণু সত্যের পূজারী। যেভাবে সকল মানুষ সচেতন ভাবেই হোক বা অসচেনভাবেই হোক,তারা সত্যেরই প্রার্থনা করে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা এসরা'র ৪৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন-সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবী,এবং যা কিছু তাদের মাঝে রয়েছে সবাই আল্লাহর তাসবিহ ও পবিত্রতার গুণগান গাইছে,এবং সকল বস্তুই আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণায় লিপ্ত। কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা তাসবিহ বা প্রশংসা ঘোষণা বোঝ না। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ফারাবির দৃষ্টিতে আকাশের পরিভ্রমণ,পৃথিবী ঘূর্ণন,বৃষ্টি পড়া এবং পানির প্রবাহ সবকিছুই তাদের আল্লাহর মহিমা ও ইবাদাতেরই লক্ষণ। মাওলানা রুমি এই ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে কটি পংক্তিও লিখেছেন।

পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণূ গোপনে
তোমার সাথে কথা বলে দিবারাত্রী
সচেতন আমরা তার সবই দেখি এবং শুনি
তোমার সাথে অচেনা আমরা তাই চুপচাপ
পার্থিব জগতের মোহে ছুটছো শুধু
খোদায়ী জ্ঞানের অধিকারী হবে কবে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এক এবং একক। তিনি স্ময়ং সম্পূর্ণ অস্তিত্বের অধিকারী। তিনি প্রকৃতিগতভাবেই সকল গুণে গুণান্বিত এবং সর্বপ্রকার দোষ-ত্রুটির উর্দ্ধে। বিশ্বের সাথে তার সম্পর্কটা হলো সৃষ্টি, ব্যবস্থাপনা, প্রেরণা বা অনুগ্রহ প্রদান করা ইত্যাদি।

আমরা যখন তাঁকে এইসব গুণাবলির মাধ্যমে চিনতে পারবো, তখন এই চেনাটাই আমাদের মাঝে স্রষ্টা সম্পর্কে বিনয়, প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা সৃষ্টি করবে। এ অবস্থায় যেই স্রষ্টা পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর ওপর ক্ষমতাবান, আকাশ এবং যমীনের সকল কিছুর ব্যবস্থাপক, তিনি মানবাত্মাকে নিজের সাথে সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ করেন এবং তাদেরকে শক্তি প্রদান করেন যাতে তাদের অন্তর প্রশান্ত হয় একং মানসিক স্থিরতা আসে।

এভাবেই সকল মানুষ এমনকি যারা পৃথিবীকে বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিতে দেখে, তাদের জীবনেও প্রশংসা এবং প্রার্থনার প্রয়োজন রয়েছে। যারা গতানুগতিক জীবন যাপন করে অর্থাৎ যাদের জীবনে প্রতিটি দিনই আগের দিনের পুনরাবৃত্তির মতো, যাদের জীবন হতাশাগ্রস্ত, তারাও চায় উন্নততরো বাস্তবতা তথা খোদার সাথে অন্তরঙ্গ হতে এবং তার প্রশংসায় লিপ্ত হতে। আসলে মানব বৈশিষ্ট্যটাই এমন যে, সে চায় বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে এবং সুখি ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে।

ইসলাম মানুষের এই প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে এবং ইবাদাতের অনুভূতি লালনের চেষ্টা করার মধ্য দিয়ে মানুষ চায় সত্যকে আবিষ্কার করতে এবং পূর্ণতায় উপনীত হতে।

নামাজ হলো ইবাদাত-বন্দেগি আর প্রশংসার সুস্পষ্টতম রূপ। নামাজ হলো ইসলামী ইবাদাতগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং দ্বীনের মূল ভিত্তিগুলোর একটি। নামাজ আদায়কারী যখন আল্লাহর স্মরণের মাধুর্যকে অনুভব করে এবং কোরআন তেলাওয়াত করে, যিকির করে, তখন সে আল্লাহর সৌন্দর্য আর বিশালত্বের মাঝে বিলীন হয়ে যায়। এরকম অবস্থায় তার অন্তরাত্মা পূত-পবিত্রতা আর পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়।-আইআরআইবি
১৯ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে