রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৬, ০৫:০৬:২৭

নামাজ মানুষের ভেতরে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে (৫ম পর্ব)

নামাজ মানুষের ভেতরে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে (৫ম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : পাঠক! নামাজ বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। নামাজ হলো আত্মার প্রতিপালক এবং আল্লাহ সান্নিধ্য লাভের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। সম্ভবত এজন্যেই নবীজী নামাজকে অভিহিত করেছেন ইসলামের পতাকা বলে। নামাজের প্রভাবশালী একটি দিক হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের ভেতরে প্রশান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। যাই হোক নামাজের আরো কিছু দিক নিয়ে আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো।

ইমাম সাদেক (আ) বলেছেন, যার মাঝে পাঁচটি জিনিস থাকবে না তার জীবন সুখকর নয়। এই পাঁচটি জিনিস হলো-সুস্থতা, নিরাপত্তা, অভাবহীনতা, পরিতৃপ্তি এবং বন্ধু বা সহচর। ইমাম সাদেক (আ) এর দৃষ্টিতে নিরাপত্তার ব্যাপারটি সৌভাগ্যের একটি চালিকাশক্তি। সকল মানব মতবাদে এবং জ্ঞানী-গুণী মনীষীর কাছে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে আসলে সুস্থ মানব জীবন বা সভ্যতা নিরাপত্তা ছাড়া গড়ে উঠতে পারে না। মার্কিন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বিল ডুরান্ট তার বিখ্যাত সভ্যতার ইতিহাস নামক গ্রন্থে লিখেছেন-সভ্যতার আবির্ভাব তখনই ঘটতে পারে, যখন নিরাপত্তাহীনতা, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটে, কেননা ভয়-ভীতি দূরীভূত হবার মাধ্যমে মনের ভেতর নতুন নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবনীর একটা উদ্দীপনা জাগে, কৌতূহল জাগে।

মানুষ তার স্বাভাবিক প্রবণতার দিকে ফিরে যায় এবং সেই প্রবণতা অনুযায়ী মানুষ জ্ঞান-আধ্যাত্মিকতা আর জীবনমান উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু সংকটপূর্ণ বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মানুষের সামনে প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে তাহলো মানুষ কীভাবে তার ব্যক্তিগত জীবনে এবং সামাজিক জীবনে নিরাপত্তা বিধান করবে। বহুকাল ধরে সমাজ বিজ্ঞানীরা নিরাপত্তা সম্পর্কে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এইসব দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের অভিজ্ঞতা এবং অধীত জ্ঞান থেকেই এসেছে এবং তা যথার্থভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে নি। একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে কিংবা মনোচিকিৎসা কেন্দ্রগুলো থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানগুলো নিয়ে চিন্তা করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে,বর্তমান যুগের মানুষ তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিক থেকে বিশেষ করে তাদের মানসিক এবং আত্মিক প্রশান্তির ক্ষেত্রে খুব বেশি একটা সাফল্য অর্জন করতে পারে নি।

কিন্তু বর্তমান যুগে এমন এমন মানুষও রয়েছেন যারা অস্থিরতা সৃষ্টিকারী বহু বিষয় থাকার পরও আত্মিক এবং মানসিক দিক থেকে ভালো আছেন এবং নিরাপদেই আছেন। এঁরা হলেন প্রকৃত নামাজী।এঁরা নামাজের আলোকিত রশ্মি দিয়ে নিজেদের অন্তরগুলোকে পলিশ করেন অর্থাৎ অন্তরে জমাট বাঁধা মরীচাগুলোকে পরিস্কার করে অন্তরগুলোকে বিনম্র ও প্রশান্ত করে তোলেন। এ ধরনের মানুষেরা কোরআনের সেই আহ্বানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছেন যেখানে বলা হয়েছে : জেনে রাখো! আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে অন্তর প্রশান্ত হয়। সূরা রা'দের ২৮ নম্বর আয়াতের অংশবিশেষ এটি। সকাল-সন্ধ্যায় আযানের যে ধ্বনি কানে বাজে,ঐ ধ্বনি শুনে মানুষ নামাজে দাঁড়ায়। এর মাধ্যমে নামাজিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে সর্বশক্তিমান তার অবস্থা লক্ষ্য করছেন এবং জীবনের উত্থান-পতনে তিনিই হলেন তার পৃষ্ঠপোষক।

নামাজীরা কখনোই আশ্রয়হীন নন কেননা তারা জানেন জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনেক বৃহৎ এবং উর্ধ্বে। আর সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার জন্যে অবশ্যই আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। নামাজ হলো এই সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান উপায়। আর যখনি নামাজে এই সম্পর্কটি স্থাপিত হয় তখনি তার অন্তর প্রশান্ত হয় এবং তার সকল অস্তিত্ব ঘিরে এক ধরনের নিরাপত্তা অনুভূত হয়। আল্লাহর নবী-রাসূলগণ এবং বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের জীবন সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা যে তৌহিদের সুগন্ধিতে বিশ্বকে ঘ্রাণময় করে তুলেছেন, তাদের সেই সাফল্যের রহস্যটা মূলত তাদের সেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তির মধ্যেই নিহিত। আর সেই নিরাপত্তা আর প্রশান্তি এসেছে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সূত্র ধরে। নবী-রাসূলগণ যখনি কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার সম্মুখিন হয়েছেন তখনি তারা নামাজ কায়েমের আহ্বান জানিয়েছেন। নামাজের একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল তাদের কাছে।

হযরত মূসা (আ) এর প্রতি ওহী নাযিল হয়েছিল যে তোমরা সারিবদ্ধ হও এবং নামাজ কায়েম কর। হযরত ইব্রাহীম (আ) ও তাঁর দোয়ায় আল্লাহর কাছে চেয়েছেন-হে পরোয়ার দেগার! আমাকে নামাজ কায়েমকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো। আমার বংশধরকেও নামাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দাও! হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার দোয়া কবুল করো। দোলনায় থাকা অবস্থায় হযরত ঈসা (আ)ও নিজেকে নামাজ কায়েম করার জন্যে আদেশপ্রাপ্ত বলে আত্মপরিচয়ে উল্লেখ করেছেন। সূরা র্মাইয়ামের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-আমি যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমার অস্তিত্বকে বরকতপূর্ণ তথা মঙ্গলময় করেছেন,যতোদিন আমি জীবিত আছি ততোদিন আমাকে নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ ! নামাজি ব্যক্তি নামাজের আলোয় থাকার ফলে তাঁর অন্তরে কোনোরকম উদ্বেগ কাজ করে না। এজন্যে নামাজির অন্তরে সবসময় প্রশান্তি বিরাজ করে। তাঁর অন্তরে ভবিষ্যত সম্পর্কে কোনোরকম ভয়-ভীতি বা অস্পষ্টতা বাসা বাঁধতে পারে না। কারণটা হলো একজন নামাজি মনে করে সকল স্থান বা কাল-ই কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে,আর তিনি তো আল্লাহর কাছেই নিজেকে সমর্পন করেছেন অর্থাৎ আল্লাহ সবসময় তাঁর সাথে সাথে রয়েছেন। তাই তিনি নির্ভীক। তিনি তাঁর বিগত দিনের ভুলগুলোর জন্যে খোদার দরবারে হতাশ হন না,কারণ তিনি জানেন আল্লাহ তওবা কবুলকারী এবং অনেক ক্ষমাশীল।

মানুষ আল্লাহু আকবার অর্থাৎ আল্লাহ বর্ণনাতীত বড়ো বলে সমগ্র সৃষ্টিকূলের স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়। সেইসাথে এ-ও স্বীকার করে যে যতোবড়ো শক্তিই থাকুক না কেন আল্লাহর শক্তিমত্তার কাছে তা তুচ্ছ এবং নগণ্য। একজন নামাজি বিসমিল্লাহির রাহ মানির রাহিম অর্থাৎ পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি বলে নামাজ শুরু করে। এর মাধ্যমে নামাজি স্মরণ করতে চায় যে আল্লাহর দয়া,মেহেরবাণী,আল্লাহর ক্ষমাশীলতার কোনো সীমারেখা নেই। এমতাবস্থায় তার অন্তরাত্মা নিরাপত্তা আর প্রশান্তিতে ভরে যায়। এরপর আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন অর্থাৎ সকল প্রশংসা উভয় জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর-ব'লে একথাই স্বীকার করে যে,প্রশংসা কেবল তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনিই এর যোগ্য। মালিকি ইয়াওমিদ্দিন অর্থাৎ বিচার বা প্রতিদান দিবসের মালিক বলে এটাই মেনে নেওয়া হয় যে আল্লাহ সকল কিছুর ওপরই তাঁর কর্তৃত্ব রয়েছে। পরিণতিতে পার্থিব জীবনের সকল বালা-মুসিবৎ তার দৃষ্টিতে সহজ স্বাভাবিক হয়ে আসে।

ইয়্যাকা না'বুদু অ-ইয়্যাকা নাস্তায়িন অর্থাৎ হে খোদা! আমরা কেবল তোমারই ইবাদাৎ করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি-ব'লে নামাজি অর্থাৎ প্রার্থনাকারী আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা প্রাপ্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে। আল্লাহর দরবারে রুকু করার মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে বিনয় প্রকাশ করা থেকে মুক্তি পায় আর সিজদা করার মাধ্যমে খোদা ব্যতিত অন্য কারো বন্দেগি করার শৃঙ্খলমুক্ত হয়। এভাবে একজন নামাজি আল্লাহর সাথে অবিচ্ছেদ্য এক সমঝোতায় উপনীত হয় যার ফলে সে পায় স্বাধীনতা , মুক্তি এবং নিরাপত্তা। কবি ইকবালের ভাষায়ঃ
هر كه پيمان با هو الموجود بست
گردنش از قيد هر معبود رست
পরম সত্ত্বার সাথে যিনিই করবেন নিরাপত্তা চুক্তি
ভ্রান্ত উপাস্যের শৃঙ্খল থেকে নিশ্চিত পাবেন মুক্তি।
২৪ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে