মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬, ০৪:২৭:৪১

নামাজ হলো মহান আল্লাহর রহমতের একমাত্র চাবিকাঠি (৭ম পর্ব)

নামাজ হলো মহান আল্লাহর রহমতের একমাত্র চাবিকাঠি (৭ম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : পাঠক! নামাজ বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের আসরে আমরা নামাজের ফায়দা এবং তার অতীত ইতিহাস নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। মানসিক অস্থিরতা এবং উত্তেজনা এমন এক ধরনের অসুখ যা বর্তমান শতাব্দীর মানুষকে হুমকিগ্রস্ত করছে। বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীরা এই সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্যে কিংবা কিছুটা হলেও মানসিক উত্তেজনা বা টেনশান কমিয়ে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রিডার্স ডাইজেস্ট ম্যাগাজিনে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম মোল্টন মার্সটেন লিখেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যে দায়িত্ববোধ রয়েছে বহু মানুষেরই সে ব্যাপারে কোনো খেয়াল নেই। এই ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা বা আপাত বিচ্ছিন্নতাই তাদের জন্যে ভুলের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি বা চিন্তা যদি কোনো একটি বিষয়কেন্দ্রিক নিবদ্ধ থাকে,তাহলে সে এই ঘাটতি বা ত্রুটি মিটিয়ে নিতে পারে।

নামাজ হলো আল্লাহর রহমতের চাবিকাঠি। নামাজের বহু আধ্যাত্মিক ফায়দা রয়েছে। তার মধ্যে একটি উপকারিতা হলো, নামাজ যদি বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ শর্ত পূরণ করে আদায় করা হয়,তাহলে মানুষের অন্তরাত্মা কেন্দ্রিভূত হয় এবং ভেতরটাকে আলোকিত করে তোলে।মানুষ যদি নামাজের ভেতর বস্তুতান্ত্রিক বিষয়-আশয় বা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে এবং আন্তরিকভাবে নামাজে উপস্থিত হয় তাহলে নিজের স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করতে পারে এমনকি জীবনের অপরাপর সমস্যাগুলোকেও কেন্দ্রিভূত করতে পারে। বিশেষ করে নামাজে সে একটি বিষয় বারবার অনুশীলন করতে পারে তাহলো-প্রতিবারই সে চেষ্টা করে নিজের অন্তরাত্মাকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করতে।

পূর্ববর্তী শরিয়তে নামাজ সম্পর্কে যে সব আয়াত এসেছে সেগুলো থেকে বোঝা যায় যে, ঐশী ধর্মের আবির্ভাবের প্রথম দিন থেকেই অসম্ভব গঠনমূলক ও অব্যাহত অনুশীলনের মাধ্যম এই নামাজের অস্তিত্ব ছিল। আল্লাহর সকল পয়গাম্বরই নামাজ কায়েম করার জন্যে আদেশপ্রাপ্ত ছিলেন এবং নিজ নিজ সন্তান ও নিজের উম্মাতকে নামাজ পড়ার ব্যাপারে আদেশ দিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তবে বিভিন্ন জাতি এবং গোত্রের মাঝে নামাজ কায়েমের পদ্ধতিগত পার্থক্য ছিল।

ইতিহাসে এসেছে, আদম এবং হাওয়া বেহেশত থেকে বেরিয়ে আসার পর যখন মাটির পৃথিবীতে পা রাখলেন,উদ্বে-উৎকণ্ঠা আর অনুতাপে দীর্ঘদিন অশ্রু ফেললেন এবং আল্লাহর দরবারে তওবা করলেন। একদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জিব্রাঈলকে তাঁদের কাছে পাঠালেন। জিব্রাঈল বললেন,আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্যে তিনি একটি হাদিয়া বা উপহার নিয়ে এসেছেন। উপহারটি হলো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার বিধান। পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগে আদম এবং হাওয়া নামাজে দাঁড়ালেন এবং অন্তরের গহীন থেকে তাঁরা আল্লাহর সাথে কথা বললেন। তারপর তাঁদের দুজনেই অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলেন। এই নামাজ তাঁদের জন্যে ছিল সর্বোত্তম একটি উপহার যেই উপহারটি মহামূল্যবান উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁদের সন্তানদের জন্যে তাঁরা রেখে গেছেন।

মক্কায় অবস্থিত মিনা এবং আরাফাতও মুসলিম জাতির জনক ইব্রাহীম (আ) এবং তাঁর সন্তান ইসমাঈল (আ) এর নামাজ আদায়ের স্মৃতি বহন করছে। চার হাজার বছর আগে তাঁরা জনগণকে এক আল্লাহর ইবাদাত করার দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) যখন তাঁর স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাঈলকে তৃণহীন পানিবিহীন মরুভূমিতে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন হাত তুলে দোয়া করে বলেছিলেন,হে পরোয়ারদিগার! আমি আমার বংশধরদের ক'জনকে তোমার পবিত্র ঘরের কাছে পানিহীন তৃণহীন এক মরুতে বসবাসের উদ্দেশ্যে রেখে এসেছি যাতে তারা নামাজ কায়েম করে।

কোরআনে হযরত ইসমাঈল (আ) এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে একখানে বলা হয়েছে তিনি নামাজের দিকে আহ্বানকারী। সূরা মারিয়ামের ৫৪ এবং ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-এবং এই গ্রন্থ অর্থাৎ কোরআনে ইসমাঈলের কথা স্মরণ করো,যিনি ছিলেন অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে সত্যবাদী আর ছিলেন একজন রাসূল ও পয়গাম্বর। তিনি সবসময় তাঁর পরিবার-পরিজনকে নামাজ এবং যাকাতের আদেশ দিতেন।

হযরত শোয়াইব (আ)ও একজন নবী ছিলেন। তাঁর কওমের লোকজন ছিল মূর্তিপূজক। তাদের বিচ্যুতি অর্থাৎ নিজেদের তৈরী প্রতিমার কাছে তাদের ভোগান্তি ও লাঞ্ছনা দেখে তিনি খুব কষ্ট পেতেন। তিনি তাঁর কওমের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন এবং আল্লাহর প্রশংসা বা ইবাদাতের সঠিক পন্থা তাদেরকে শেখাতেন। কখনো কখনো তাদের সামনে নামাজ পড়তেন এবং এক আল্লাহর কাছে নিজেদের অভাব অভিযোগ তুলে ধরে মোনাজাত দিতেন। কিন্তু তাঁর কওমের লোকজন এসবের জন্যে তাঁকে ভর্ৎসনা করতো এবং নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। তারা বলতোঃ হে শোয়াইব! তোমার নামাজ কি তোমাকে এই আদেশ দেয় যে,আমাদের পূর্বপুরুষেরা যার উপাসনা করতো তাকে বর্জন করতে হবে....?

কোরআন যখন হযরত ইসহাক এবং ইয়াকুব সম্পর্কে কথা বলে,তখন একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। প্রসঙ্গটি হলো আল্লাহর আদেশে জনগণকে হেদায়েত করা,ভালো কাজ করার আদেশ দেওয়া,নামাজ কায়েম করা এবং যাকাত দেওয়ার আদেশ দিতে তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহিপ্রাপ্ত ছিলেন। হযরত মূসা (আ) আল্লাহর অনেক বড়ো একজন পয়গাম্বর ছিলেন। আল্লাহর দরবারে বিনয় এবং ভদ্রতার জন্যে তিনি বিখ্যাত ছিলেন।

ঐকান্তিক নিষ্ঠা এবং প্রেমবোধ নিয়ে তিনি আল্লাহর সাথে কথা বলতেন। সেজন্যে তিনি মূসা কালিমুল্লাহ উপাধি পেয়েছিলেন।এক হাদিসে এসছেঃআল্লাহ তায়ালা তাঁকে খেতাব করে বলেছেন-হে মূসা! তুমি যেখানেই বা যখনই নামাজ পড়ো,অত্যন্ত বিনয়ের সাথে যমিনে সিজদা করো। মূসা (আ) যখন নবুয়্যত প্রাপ্ত হন,তাঁর ওপর আল্লাহর সর্বপ্রথম আদেশটিই ছিল নামাজ কায়েম করার ব্যাপারে। সূরা ত্বা-হা'র ১৩ এবং ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। এখন তোমার ওপর যা ওহী করা হয় তা-ই শোনো। আমি আল্লাহ',আমি ছাড়া আর কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই। আমার ইবাদাত করো আর আমার স্মরণের জন্যে নামাজ কায়েম করো।

কোরআনে কারিমের অন্য এক আয়াতে হযরত যাকারিয়া (আ) এবং লোকমান হাকিমের নামাজ পড়া এবং তাদের সন্মানদের নামাজ পড়তে বলার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর আগে নামাজ পড়ার বিষয়টি হযরত ঈসা (আ) এর একটি প্রসঙ্গ থেকেও প্রমাণিত হয়। ঈসা (আ) যখন নবজাতক শিশু,তখন তাঁর মা মারিয়ামের পবিত্রতার সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে আল্লাহর আদেশে তিনি কথা বলেছিলেন।তিনি বলেছিলেনঃ আমি আল্লাহর বান্দা, তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন এবং আমি যেখানেই থাকি না কেন,আমার অস্তিত্বকে বরকতময় করেছেন এবং যতোদিন আমি জীবিত আছি,আমাকে নামাজ পড়া এবং যাকাত দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
২৬ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে