বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৬, ০৫:২৪:১৪

নামাজ হলো মুমিনের জন্য মেরাজ স্বরূপ (৮ম পর্ব)

নামাজ হলো মুমিনের জন্য মেরাজ স্বরূপ (৮ম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : পাঠক! নামাজ বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের আসরে আমাদের আলোচনা হলো নামাজ মানুষের মুক্তি ও সৌভাগ্যের মাধ্যম। তাই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র হাদীসে বলা হয়েছে, নামাজ মুমিনের মেরাজ বা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম।

নামাজ সম্পর্কে একজন কবি বলেছেন,
নামাজের পাখায় চড়ে যাব আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে
চাইব খোদার কাছে সফরের অনুমতি নামাজের রহস্যে
" আমি" আবার কে? তাই তো বলি:
তাঁর স্মরণ বা জিকির রয়েছে ঠোটে আমার,
এ ঠোট বা জিহবা তো তাঁরই দান
(কোনো কিছুতেই) নেই আমার কোনো অবদান,
এ নামাজ নয় আমার বা তোমার,
বরং তিনিই তো মালিক নামাজের।

ইসলাম ধর্মকে দূর্বল হিসেবে তুলে ধরার জন্য ইহুদি পন্ডিতরা একবার এক ফন্দি আঁটে। এ ফন্দি অনুযায়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে জ্ঞানের দিক থেকে দূর্বল হিসেবে তুলে ধরার জন্য ইহুদি পন্ডিতরা তাঁকে কিছু জটিল প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেয়। আল্লাহর সর্বশেষ (সাঃ) রাসূল এইসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না এবং এর ফলে তাঁর ও ইসলাম ধর্মের দূর্বলতা মানুষের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হবে বলে ইহুদি পন্ডিতরা ভেবেছিল।

কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে মসজিদে প্রকাশ্য জনসভায় বিশ্বনবী (সাঃ) ইহুদি পন্ডিতদের জটিল সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন এবং তারা সবাই উত্তর পেয়ে বিস্মিত হল। সবশেষে ইহুদি পন্ডিতদের নেতা তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি উত্থাপন করে রাসূল (সাঃ)কে জব্দ করতে চাইলেন। ঐ পন্ডিত বললেন, হে মুহাম্মাদ! বলুন তো দেখি আল্লাহ কেন দিন ও রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আপনার ওপর ফরজ   বা বাধ্যতামূলক করেছেন ? কেন এর চেয়ে কম বা বেশী করা হল না ?

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র চোখে তখন বিদ্যুৎ খেলছিল এবং মহান আল্লাহর প্রেমে তাঁর নূরানী চেহারা ছিল উদ্ভাসিত । তিনি বললেন,  যোহরের নামাজের সময় আল্লাহর আরশের নীচে অবস্থিত সব কিছু আল্লাহর প্রশংসা করে ও তাঁর গুণ-গানে মশগুল হয়। আর এ জন্যই আল্লাহ এ সময় অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পর আমার ও আমার উম্মতের জন্য নামাজ ওয়াজেব করেছেন এবং এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন, সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিমে হেলে পড়ার পর থেকে অন্ধকার নেমে আসার সময় পর্যন্ত নামাজ আদায় কর।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আসরের নামাজ ফরজ বা বাধ্যতামূলক হবার কারণ সম্পর্কে বললেন, আসরের সময় হল সেই সময় যখন হযরত আদম (আঃ) তার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত গাছের ফল খেয়েছিলেন। ফলে আল্লাহ তাঁকে বেহশত থেকে বহিষ্কার করেন। আল্লাহ আদমের সন্তানদেরকে আসরের নামাজ পড়তে বলেছেন এবং আমার উম্মতের জন্যও তা ওয়াজেব করা হয়েছে। এই নামাজ মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নামাজসমূহের মধ্যে অন্যতম।

এরপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মাগরিবের নামাজ ফরজ বা বাধ্যতামূলক হবার কারণ সম্পর্কে বললেন, মহান আল্লাহ অনেক বছর পর হযরত আদম (আঃ)'র তওবা কবুল করেন এবং তিনি তখন তিন রাকাত নামাজ আদায় করেন। আল্লাহ আমার উম্মতের জন্যও মাগরিবের নামাজ বাধ্যতামূলক করেছেন, কারণ এ সময় দোয়া কবুল হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা রাত নেমে আসার সময় ও সকালে আল্লাহর প্রশংসা কর।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এশা'র নামাজ ফরজ বা বাধ্যতামূলক হবার কারণ সম্পর্কে বললেন, কবরে ও কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ অন্ধকারগুলো এশা'র নামাজের আলোয় কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। আল্লাহ বলেছেন, এশা'র নামাজ আদায়ের জন্য অগ্রসর হওয়া এমন কোনো ব্যক্তি নেই যাকে আল্লাহ দোযখ বা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন না। আর ফজরের নামাজের দর্শন হল, সূর্য-পূজারীরা সূর্য উদয়ের সময়ে এবাদত করতো। তাই আল্লাহ কাফেরদের সিজদার আগেই ইবাদতে মশগুল হতে মুমিনদেরকে ফজরের নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।

৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে বিশ্বনবী (সাঃ)'র কাছ থেকে বক্তব্য শোনার পর ইহুদি পন্ডিতরা লা-জওয়াব হয়ে গেলেন। কারণ, তাদের আর বলার কিছুই ছিল না। ফলে তারা অবনত মস্তকে মসজিদ ত্যাগ করে।

ইসলামের প্রতিটি বিধি-বিধানের রয়েছে যুক্তি ও দর্শন। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজকাল ইসলামের কোনো কোনো বিধানের স্বাস্থ্যগত, নৈতিক ও মানসিক কল্যাণের কিছু রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ফরাসী দার্শনিক ডক্টর অ্যালেক্সিস কার্ল বলেছেন, নামাজ মানুষের অনুভূতিগুলোর পাশাপাশি তার শরীরের ওপরও প্রভাব রাখে। এবাদত বা নামাজ কখনও কখনও খুব কম সময়ে রোগীদের অবস্থার উন্নতি ঘটায়। লর্ডের চিকিৎসা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রার্থণার পর রোগ সেরে গেছে এমন ২০০'রও বেশি ঘটনা রেকর্ড করেছে।

আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় প্রমাণিত হয়েছে যে মহান আল্লাহর ইবাদত বা তাঁর কাছে প্রার্থণার ফলে হাই-ব্লাড প্রেশার বা রক্তের উচ্চ-চাপ বৃদ্ধি প্রতিহত হয়। যারা নিয়মিত প্রার্থণাকেন্দ্রে যান তারা রক্ত-চাপ, হৃদরোগ, যক্ষা ও ক্যান্সারের মত অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকেন বলে রিডার্স ডাইজেস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

মানুষের মন ও প্রাণকে প্রজ্জ্বোল আলোয় উদ্ভাসিত করার চির-সুন্দর এবাদত নামাজ আল্লাহর সাথে সংযোগের গভীর সেতু-বন্ধন। মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে নামাজ। তাই নামাজের আধ্যাত্মিক কল্যাণ ছাড়াও অন্য অনেক কল্যাণ থাকাও স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নামাজে বার বার ওঠা ও বসার ফলে মানুষের শরীরে রক্ত-সঞ্চালনের গতি বাড়ে। নামাজ মানুষের পরিপাকযন্ত্র ও হজমের প্রক্রিয়াকেও শক্তিশালী করে এবং এর ফলে মানুষের খাবারের রুচিও বাড়ে।

তবে এটাও মনে রাখা দরকার মানুষের জ্ঞান আল্লাহর অসীম জ্ঞানের তুলনায় খুবই সিমীত ও তুচ্ছ। তাই কেউ যদি আল্লাহর কোনো বিধানের কল্যাণকামী দর্শন বা উপকারিতার বিষয়টি বুঝতে বা আবিষ্কার করতে না পারেন তাহলে ঐ বিধানটি ত্যাগ করতে হবে এমন ধারণা অযৌক্তিক। নামাজ মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এমন এক ইবাদত যা খোদাপ্রেমিক মানুষ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার নির্দেশ পালনের জন্যই আদায় করে থাকেন।

বস্তুগত কোনো কল্যাণ কিংবা বেহেশতের আশা ও দোযখের ভয় এক্ষেত্রে কোনোক্রমেই মূল বিবেচ্য বিষয় নয়। নামাজ পড়া যদি বাধ্যতামূলক নাও হতো, তবুও আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দারা তা আদায় করতেন।
মহান আল্লাহ যেন আমাদেরকে নামাজের তাৎপর্য ও রহস্যগুলো ভালোভাবে জানার এবং জীবনের সবক্ষেত্রে সেগুলো প্রয়োগের তৌফিক দেন- এই প্রার্থণা জানিয়ে শেষ করছি আজকের এ আলোচনা।
২৭ এপ্রিল, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে