ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। অসীম দয়ালু আল্লাহর সামনে মানুষ অক্ষম এবং অতিশয় ক্ষুদ্র। মহান স্রষ্টার সাথে এই ক্ষুদ্র সত্ত্বার সম্পর্ক যার মাধ্যমে স্থাপিত হয় তা হলো নামাজ। সৌভাগ্য ও মুক্তি অর্জনের ইচ্ছা মানুষের চিরন্তন প্রকৃতি। নামাজ মানুষের এই চাহিদা মেটায়। নামাজে আমরা যেসব বাক্য উচ্চারণ করি ও যেসব জিকির বা শপথের পুনরাবৃত্তি করি সেসবই তৌহিদ বা একত্ববাদ, নবুওত, পরকাল এবং সামাজিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার নির্যাস।
এসব শিক্ষা ইসলামী শিক্ষারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুওত লাভের পর পরই মানুষ গড়ার ও ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিগুলোকে মজবুত করার কাজে মশগুল হয়েছিলেন। তাঁর এই মিশন শুরু হয়েছিল মুসলমানদেরকে নামাজ ও অন্যান্য এবাদত শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে। নামাজ ইসলামের বৈশ্বিক কর্মসূচী এবং বিশ্বজনীন শিক্ষা ও আদর্শের এক প্রোজ্জ্বোল দৃষ্টান্ত। পবিত্র কোরআনে নামাজ অর্থে সালাত বা তার সমার্থক শব্দ ও প্রতিশব্দ রয়েছে প্রায় ৯৮ টি। আর এ থেকেই এই এবাদতের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে।
হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ) ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র বিশিষ্ট বিশ্বস্ত সাহাবী এবং আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)'র নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ছিলেন মহানবী (সাঃ)'র এমন এক সাহাবী যিনি তাঁকে না দেখেই এক আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছিলেন। রাতের বেলায় দীর্ঘ সিজদার পর আকাশের দিকে তাকাতেন এবং উজ্জ্বল তারকারাজি প্রত্যক্ষ করতেন। প্রতিদিন সকালে এবাদতের পর তিনি হয়ে উঠতেন আরো প্রাণবন্ত, উৎফুল্ল ও আশাবাদী। হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ) যে সারা রাত জেগে এবাদত করতেন, এটা সে যুগের সবাই জানতেন। মহান আল্লাহর দরবারে মনের আকুতি, অনুনয় আর বিনীত নিবেদনগুলো তুলে ধরতেন নিজ প্রার্থণায়।
কেউ কেউ বলতেন, হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ) সারা রাত কাটিয়ে দিতেন সিজদারত বা রুকুরত অবস্থায়। তবে কেউ কেউ এ বিষয়টাকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করতেন। মানুষের শরীর কিভাবে এতো ধকল বা কষ্ট সইতে পারে? -এটাই ছিল তাদের প্রশ্ন। হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ)'র সামনে এ ধরনের সন্দেহ বা প্রশ্ন উচ্চারিত হলে তিনি কিছু না বলে মুচকি হাসতেন।
হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ)-কে একদিন এক ব্যক্তি বললেন, আপনি সারা রাত জেগে নামাজ পড়েন বলে শুনেছি, অথচ আল্লাহ তো তার বান্দার ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। জবাবে ওয়াস কুরুনী (রাঃ) যথারীতি স্মিত হাসি হেসে প্রশান্ত চিত্তে দিগন্তের দিকে তাকালেন। তিনি দেখলেন লোকটি তার বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। এ অবস্থায় হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ) বললেন, "এবাদত ও নামাজ আমার কাছে বিশ্রাম এবং চিত্ত-বিনোদন বা প্রশান্তিতে সময় কাটানোর সমতূল্য। আহা! যদি একটি রাতই সৃষ্টির সূচনা থেকে অসীম সময় পর্যন্ত দীর্ঘ হতো! আর আমি যদি ঐ রাতটা রুকু অথবা সিজদারত অবস্থায় কাটিয়ে দিতে পারতাম!"
লোকটি হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ)'র এ বক্তব্য শোনার পর প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ) যেন তার কাছে এক নতুন অধ্যায় বা দিগন্ত খুলে দিলেন। ঐ ব্যক্তি জানতেন, মানুষের মন যখন প্রশান্ত থাকে, তখন শরীরও প্রশান্তি লাভ করে। হযরত ওয়াস কুরুনী (রাঃ)'র ঘর থেকে বের হবার সময় লোকটি আবৃত্তি করলেন পবিত্র কোরআনের এই অমৃত-বাণীঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি।' ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, অস্থিরতা বা অস্থির মন মানুষের ব্যক্তিত্বের একটি দূর্বলতা। এ ধরনের মানুষ ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সিদ্ধান্তহীনতার শিকার এ ধরনের ব্যক্তি যে মানসিক রোগী তা তারা নিজেরাও জানেন না। সমাজে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
মনোস্তাত্ত্বিকদের মতে, মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে বংশগতি বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, শারীরিক গঠন, শরীরের হরমোন এবং রাসায়নিক উপাদানের মত বাহ্যিক চালিকা-শক্তিগুলোর প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়াও প্রভাব রয়েছে পিতা-মাতা, পরিবার এবং মূল্যবোধসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার মত বাহ্যিক বিভিন্ন চালিকা-শক্তির। মনোস্তাত্ত্বিকরা বলছেন, নামাজ মানুষের ব্যক্তিত্বের দূর্বলতাগুলো দূর করার মোক্ষম পন্থা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ডক্টর মজিদ মালেক মোহাম্মদী বলেছেন, "নামাজী বা মুসল্লীদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হ'ল, তারা খোদার বিধানের কাছে আত্ম-সমর্পিত। তারা সরল পথে থাকেন। প্রতিদিন নামাজে পঠিত আধ্যাত্মিক-বাক্য ও শব্দগুলো নামাজীকে কিছু বিশ্বাস এবং মূলনীতির সাথে সম্পর্কিত করে। ফলে তিনি স্থিরমতি হন এবং একটি সুনির্দিষ্ট পথ বেছে নেন। আর ঐসব আধ্যাত্মিক বাক্য ও শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তির ফলে তিনি হয়ে উঠেন সুস্থির এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃঢ়-চিত্তের অধিকারী। ব্যক্তিত্বের স্থিরতা ও ভারসাম্যপূর্ণ মানসিক অবস্থা একজন মানুষের জীবনে সাফল্য বয়ে আনার জন্য জরুরী।"
ডক্টর মজিদ মালেক মোহাম্মদী আরো বলেছেন, নামাজ সমাজে কোনঠাসা বা একঘরে হয়ে পড়া ব্যক্তিত্বের জন্যেও সংকট কাটিয়ে তোলার মাধ্যম। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, ইসলাম প্রাত্যহিক নামাজগুলোকে জামাতে আদায় করার ওপর জোর দিয়েছে। একইসাথে প্রাণসঞ্জিবনী জুমার নামাজ মানুষকে উৎসাহ-উদ্দীপনায় টইটম্বুর এক মহতি সমাবেশে একত্রিত করে। ইসলাম যে সামাজিক বা সমাজবদ্ধ ধর্ম জুমার নামাজ তার দৃষ্টান্ত।
ইসলামের এসব শিক্ষা নামাজীকে সামাজিক হতে উৎসাহ দেয়। সূরা ফাতিহায় বার বার সমষ্টিবাচক শব্দ বা বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। নামাজের প্রত্যেক রাকাতের পাঠ্য এ সূরা মানুষের একাকীত্ব-পিয়াসী বা স্বাতন্ত্রতাকামী মনোভাব দূর করে। তাই দেখা যায়, ইসলাম সমাজকে ব্যক্তির চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়। যেমন, সূরা ফাতিহায় বলা হয়েছে, আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং একমাত্র তোমারই কাছে সাহায্য চাই। এভাবে নামাজ মানুষকে নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের সংকট থেকে মুক্তি দেয় এবং এ ধরনের মানুষকে সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করে।
১ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই